যুগপৎ আন্দোলনের ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী আজ জেলা ও মহানগর পর্যায়ে বাকশাল গঠনের দিনটি ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করবে বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো। যুগপৎ আন্দোলনের চতুর্থ কর্মসূচি এটি। কেন্দ্রীয়ভাবে নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করবে বিএনপি। আজকের কর্মসূচি থেকে ফের বিক্ষোভ-সমাবেশ কর্মসূচি দেওয়া হতে পারে। বিএনপির কর্মসূচির দিন আওয়ামী লীগ পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে নেতাকর্মীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি এ বিক্ষোভ হতে পারে। আওয়ামী লীগ ও পুলিশের জুলুম-নির্যাতনের প্রতিবাদে কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। এর সঙ্গে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য কমানোর দাবিটিও যুক্ত করা হতে পারে।
৯ বিভাগীয় গণসমাবেশ সফল করায় নেতাকর্মীদের মাঝে আন্দোলনের গতি ছিল বিএনপির প্রত্যাশারও বাইরে। কিন্তু ১০ ডিসেম্বর ঢাকা সমাবেশের আগে ‘আন্দোলনের মূল নেতা’ মহাসচিবসহ দলের সিনিয়র নেতারা গ্রেপ্তার হলে সেই গতি কমে যায়। এই অবস্থায় আগের গতিতে ফিরতে চায় দলটি। এ জন্য এবার তৃণমূলের পাশাপাশি রাজধানী ঢাকাকে উজ্জীবিত করার পরিকল্পনা করছে দলটি। সে ক্ষেত্রে ঢাকায় ব্যতিক্রমী কী কর্মসূচি গ্রহণ করা যায়, তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আন্দোলনের লিয়াজোঁ কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু আমাদের সময়কে বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য এক দফার আন্দোলন। চূড়ান্ত আন্দোলনে যেতে আমাদের ওয়ার্মআপ কর্মসূচি চলছে। আমাদের আন্দোলনের পক্ষে দেশের গণতন্ত্রপ্রিয় রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। এরশাদ যেমন পদত্যাগে বাধ্য হয়েছে; এই সরকারও সময় হলে পদত্যাগ করতে বাধ্য হবে। এই সরকারকে যেতে হবে।’
এদিকে আজ শুরু হওয়া যুগপৎ আন্দোলনের চতুর্থ দফা কর্মসূচি প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক পন্থায় ত্রাস সৃষ্টি করার লক্ষ্যে বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির সময় পাল্টা কর্মসূচি ঘোষণা করছে। তাদের নেতৃবৃন্দের উসকানিমূলক বক্তব্য বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ও সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ্যেই বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের হাত-পা ভেঙে দেওয়া, হাত জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি ও নির্দেশ ক্ষমতাসীন দলের সন্ত্রাসীদের আরও অনুপ্রাণিত করেছে।
দলের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, এ বিক্ষোভ কর্মসূচির পর ঢাকার একস্থান থেকে অন্যস্থানে পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটি। একই সময়ে জেলা পর্যায়েও একই কর্মসূচি দেওয়া যায় কিনা আলোচনা চলছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, আগামী মাসে রাজধানী ঢাকায় ফুটপাত দিয়ে পদযাত্রা কর্মসূচির বিষয়ে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দলের গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা বলেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্য জনসম্পৃক্ততা বাড়িয়ে আন্দোলনের গতি বৃদ্ধি করা। এ জন্য এমন কিছু কর্মসূচি নেওয়া হবে যাতে করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টির কথা বলে সরকার বাধা দিতে না পারে। আবার আমরাও যেন কর্মসূচি সফল করতে পারি।’
কর্মসূচি চূড়ান্ত করতে গত সোমবার রাতে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটি বৈঠক করেছে। সেখানেও কর্মসূচিতে ভিন্নতা আনতে নেতারা পরামর্শ দেন। বৈঠকে অংশ নেওয়া নেতারা বলেন, যুগপৎ আন্দোলন যে উদ্যম নিয়ে শুরু হয়েছে, তাতে ভাটা পড়েছে। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী অন্য দলগুলোও প্রত্যাশা অনুযায়ী কার্যকরভাবে কর্মসূচি পালন করছে না। ফলে নেতাকর্মীদের মধ্যে শৈথিল্য ও হতাশা তৈরি হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলেন, গত বছর অনুষ্ঠিত বিভাগীয় সমাবেশ ঘিরে চরম উত্তেজনা তৈরি হয়েছিল। কর্মসূচি দেওয়ার আগে তা কেউ ভাবেনি। দিন-তারিখ ঠিক করে আন্দোলনকে সেই পর্যায়ে নেওয়া কঠিন। তবে আন্দোলনকে চূড়ান্ত রূপ দিতে ১০ ডিসেম্বরের আগের অবস্থায় কীভাবে নেওয়া যায়, সে ব্যাপারে দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে আলোচনা চলছে।
ঢাকাসহ সারাদেশে সমাবেশ: আজ সারাদেশে সমাবেশ করবে বিএনপি। দুপুর ২টায় নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিএনপির সমাবেশে প্রধান অতিথি থাকবেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, ড. আবদুল মঈন খান ও সেলিমা রহমান বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন।
বিএনপির দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স জানান, ঢাকা ছাড়া বিভিন্ন মহানগরে কেন্দ্রীয় ১১ নেতা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মধ্যে বরিশালে গয়েশ্বরচন্দ্র রায়, চট্টগ্রামে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এবং রাজশাহীতে থাকবেন ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। ভাইস চেয়ারম্যানদের মধ্যে গাজীপুরে বরকতউল্লাহ বুলু, কুমিল্লায় মো. শাহজাহান, সিলেটে ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, ময়মনসিংহে শামসুজ্জামান দুদু, রংপুরে আহমেদ আজম খান ও খুলনায় প্রধান অতিথি থাকবেন নিতাই রায় চৌধুরী। যুগ্ম মহাসচিবদের মধ্যে নারায়ণগঞ্জে যাবেন সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল এবং ফরিদপুরে থাকবেন হাবিব উন নবী খান সোহেল।
অন্যান্য দলের কর্মসূচি: বিএনপি ছাড়াও রাজধানীতে সমমনা দলগুলো সাতটি স্থানে সমাবেশ করবে। বেলা সাড়ে ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে গণতন্ত্র মঞ্চ, বিকাল ৩টায় বিজয়নগর পানির ট্যাংকসংলগ্ন সড়কে ১২ দলীয় জোট, বেলা ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ১২ দলীয় জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, দুপুর আড়াইটায় পূর্ব পান্থপথের এফডিসি সংলগ্ন দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), বেলা ১১টায় আরামবাগে মোস্তফা মোহসীন মন্টুর নেতৃত্বাধীন গণফোরাম ও বাবুল সর্দার চাখারীর নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ পিপলস পার্টি, বেলা ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের (পূর্ব প্রান্তে) সামনে চার দলের গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য সমাবেশ করবে।
এ ছাড়া ১৫ সংগঠনের ‘সমমনা পেশাজীবী গণতান্ত্রিক জোট’ বেলা ১১টায় পুরানা পল্টন মোড়ে বিক্ষোভ সমাবেশ করবে। তবে ঢাকা জেলা বিএনপি সমাবশের জন্য কোথাও অনুমতি পায়নি বলে জানান জেলা নেতারা।
স্থায়ী কমিটির বৈঠক: দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে গত সোমবার রাতে অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল সভার সিদ্ধান্ত গতকাল মঙ্গলবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানান মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এতে বলা হয়, এই সভায় উৎপাদন শুরুর মাত্র ২৭ দিনের মাথায় কয়লার অভাবে রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ, ডলারের মূল্য পরিশোধ করতে না পারায় চট্টগ্রাম বন্দরে আসা তিনটি জাহাজের চিনি ও ভোজ্যতেল খালাস না করা, এবার হজযাত্রীদের ওপর ডলার সংকটের প্রভাব, এলসি গ্রহণে বিদেশি ব্যাংকের অনীহা সামগ্রিকভাবে ডলার সংকট অর্থনীতিতে গভীর সংকট সৃষ্টি করায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। সভা মনে করে, এই অবৈধ সরকারের অর্থনীতির সর্বক্ষেত্রে লাগামহীন দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণেই বর্তমানে ডলার সংকট ও অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
সভায় সদ্য প্রকাশিত স্কুল পাঠ্যপুস্তকে ইতিহাস ও বিষয়বস্তুর বিকৃতি, ভুল তথ্য ও ভাষাগত ভুলের দোষে দুষ্ট এবং ধর্মীয় মূল্যবোধে আঘাত বিষয়ে তীব্র অসন্তোষ জানানো হয়। সভা মনে করে, অবৈধ সরকার পরিকল্পিতভাবে হীন উদ্দেশ্যে শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করার লক্ষ্যে ঐতিহ্যগত সংস্কৃতি, জীবনমান, মূল্যবোধবিরোধী কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের ভ্রান্ত, বিকৃত ও অসত্য তথ্য শিক্ষা দিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। সভায় এই অপচেষ্টার তীব্র নিন্দা জানানো হয় এবং অবিলম্বে পুস্তকগুলো বাতিল করে বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাস ও মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে পুস্তক রচনার দাবি জানানো হয়।