ঢাকা , বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

রেকর্ড হচ্ছে প্রতিটি কথা ও কাজ

  • সূর্যোদয় ডেস্ক:
  • আপডেট সময় ১২:০১:৩২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৩ নভেম্বর ২০২৩
  • ১১১০ বার পড়া হয়েছে

এক দিকে স্বয়ং আল্লাহ নিজে সরাসরি মানুষের প্রতিটি গতিবিধি এবং চিন্তা ও কল্পনা সম্পর্কে অবহিত। অপর দিকে প্রত্যেক মানুষের জন্য দু’জন ফেরেশতা নিয়োজিত আছেন যারা তার প্রত্যেকটি তৎপরতা লিপিবদ্ধ করছেন। তার কোনো কাজ ও কথাই তাদের রেকর্ড থেকে বাদ পড়ে না। অর্থাৎ আল্লাহর আদালতে যে সময় মানুষকে পেশ করা হবে তখন কে কী করে এসেছে সে বিষয়ে আল্লাহ নিজ থেকেই অবহিত থাকবেন। তা ছাড়া সে বিষয়ে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য এমন দু’জন সাক্ষীও উপস্থিত থাকবেন যারা তার কাজকর্মের লিখিত নথিভুক্ত প্রমাণাদি এনে সামনে পেশ করবেন। লিখিত এ প্রমাণাদি কেমন ধরনের হবে তার সঠিক ধারণা করা আমাদের জন্য কঠিন। তবে আজ আমাদের সামনে যেসব সত্য উন্মোচিত হচ্ছে তা দেখে এ বিষয়টি একেবারে নিশ্চিত মনে হয় যে, যে পরিবেশে মানুষ অবস্থান ও কাজকর্ম করে তাতে চতুর্দিকের প্রতিটি অণু-পরমাণুর ওপর তার কণ্ঠস্বর, ছবি ও গতিবিধির ছাপ পড়ে যাচ্ছে। এসব জিনিসের প্রত্যেকটিকে পুনরায় হুবহু সেই আকার-আকৃতি ও স্বরে এমনভাবে পেশ করা যেতে পারে যে, আসল ও নকলের মধ্যে সামান্যতম পার্থক্যও থাকবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘এমন কোনো শব্দ তার মুখ থেকে বের হয় না যা সংরক্ষিত করার জন্য একজন সদা প্রস্তুত রক্ষক উপস্থিত থাকে না।’ (সূরা কাফ-১৮)

মানুষ যন্ত্রপাতির সাহায্যে এ কাজটি অত্যন্ত সীমিত মাত্রায় করছে। কিন্তু আল্লাহর ফেরেশতারা এসব যন্ত্রপাতিরও মুখাপেক্ষী নয়, এসব প্রতিবন্ধকতায়ও আবদ্ধ নয়। মানুষের নিজ দেহ এবং তার চার পাশের প্রতিটি জিনিস তাদের জন্য টেপ ও ফিল্ম-স্বরূপ। তারা এসব টেপ ও ফিল্মের ওপর প্রতিটি শব্দ এবং ছবি অতি সূক্ষ্ম ও খুঁটিনাটি বিষয়সহ অবিকল ধারণ করতে পারে এবং পৃথিবীতে ব্যক্তি যেসব কাজ করত কিয়ামতের দিন তাকে তার নিজ কানে নিজ কণ্ঠস্বরে সেসব কথা শুনিয়ে দিতে পারে, নিজ চোখে তার সব কর্মকাণ্ডের এমন জ্বলজ্যান্ত ছবি দেখিয়ে দিতে পারে যা অস্বীকার করা তার জন্য সম্ভব হবে না। প্রযুক্তির ক্রমোন্নতি এ সত্য দিন দিন সুস্পষ্ট হচ্ছে।
এখানে এ কথাটিও ভালোভাবে বুঝে নেয়া দরকার যে, আল্লাহ তায়ালা আখিরাতের আদালতে কোনো ব্যক্তিকে কেবল নিজের ব্যক্তিগত জ্ঞানের ভিত্তিতে শাস্তি দেবেন না; বরং ন্যায়বিচারের সমস্ত পূর্বশর্ত পূরণ করে তাকে শাস্তি দেবেন। এ কারণে দুনিয়াতেই প্রত্যেক ব্যক্তির সমস্ত কথা ও কাজের পূর্ণাঙ্গ রেকর্ড তৈরি করা হচ্ছে যাতে অনস্বীকার্য সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তার সমস্ত কর্মকাণ্ডের প্রমাণাদি পেশ করা যায়।

এ কথাটিকে আরো সুষ্ঠুভাবে সূরা ইনফিতারে বলা হয়েছে- ‘অথচ তোমাদের ওপর পরিদর্শক নিযুক্ত রয়েছে, এমন সম্মানিত লেখকবৃন্দ, যারা তোমাদের প্রত্যেকটি কাজ জানে।’ (আয়াত : ১০-১২) এটি পূর্বাপর আলোচনার অংশ। অর্থাৎ বলা হচ্ছে- মানুষ চাইলে কর্মফল দিবসকে অস্বীকার করতে পারে; কিন্তু এতে প্রকৃত সত্য বদলে যাবে না। প্রকৃত সত্য হচ্ছে এই যে, তাদের রব এই দুনিয়ায় তাদেরকে লাগামহীনভাবে ছেড়ে দেননি; বরং তিনি তাদের প্রত্যেকের ওপর অত্যন্ত সত্যনিষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করে রেখেছেন। তারা নিরপেক্ষভাবে তাদের সমস্ত ভালো ও মন্দকাজ রেকর্ড করে যাচ্ছে। তাদের কোনো কাজ সম্মানিত তত্ত্বাবধায়কের অগোচরে থাকছে না। মানুষ অন্ধকারে, একান্ত নির্জনে, জনমানবহীন গভীর জঙ্গলে অথবা এমন যেকোনো অবস্থায় কোনো কাজ করে থাকলে যে সম্পর্কে মানুষ পূর্ণ নিশ্চিন্ত থাকছে যে, তা সব সৃষ্টির অগোচরে রয়ে গেছে, তারপরও তা তাদের কাছ থেকে গোপন থাকছে না। এই তত্ত্বাবধায়ক ফেরেশতাদের জন্য আল্লাহ ‘কিরামান কাতেবিন’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ লেখকবৃন্দ যারা কারিম। অত্যন্ত সম্মানিত ও মর্যাদাবান। তাদের কারোর সাথে ব্যক্তিগত ভালোবাসা বা শত্রুতা নেই। ফলে একজনের প্রতি অন্যায় পক্ষপাতিত্ব ও অন্যজনের প্রতি অযথা বিরোধিতা করে সত্যবিরোধী ঘটনা রেকর্ড করার কোনো অবকাশই সেখানে নেই। তারা খেয়ানতকারীও নয়। ডিউটি ফাঁকি দিয়ে নিজেদের তরফ থেকে খাতায় উল্টো-সিধে লিখে দেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তারা ঘোষখোরও নয়। নগদ কিছু নিয়ে কারো পক্ষে বা কারো বিপক্ষে মিথ্যা রিপোর্ট দেয়ার কোনো প্রশ্নই তাদের ব্যাপারে দেখা দেয় না। এসব নৈতিক দুর্বলতা থেকে তারা মুক্ত। কাজেই সৎ ও অসৎ উভয় ধরনের মানুষের নিশ্চিত থাকা উচিত যে, তাদের প্রত্যেকের সৎকাজ হুবহু রেকর্ড করা হবে এবং কারোর ঘাড়ে এমন কোনো অসৎ কাজ চাপিয়ে দেয়া হবে না, যা সে করেনি।

তারপর এই আয়াতে এই ফেরেশতাদের দ্বিতীয় যে গুণটি বর্ণনা করা হয়েছে তা হচ্ছে- ‘তোমরা যা কিছু করো তা তারা জানে।’ অর্থাৎ, তাদের অবস্থা দুনিয়ার সিআইডি ও তথ্য সরবরাহ এজেন্সিগুলোর মতো নয়। সব রকমের প্রচেষ্টা ও সাধ্য-সাধনার পরও অনেক কথা তাদের কাছ থেকে গোপন থেকে যায়। কিন্তু এ ফেরেশতারা প্রত্যেক ব্যক্তির প্রত্যেকটি কথা ও কাজ সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত। সব জায়গায় সব অবস্থায় সব ব্যক্তির সাথে তারা এমনভাবে লেগে আছে যে, তারা জানতেই পারছে না, কেউ তাদের কাজ পরিদর্শন করছে। কোন ব্যক্তি কোন নিয়তে কী কাজ করেছে তাও তারা জানতে পারে। তাই তাদের তৈরি করা রেকর্ড একটি পূর্ণাঙ্গ রেকর্ড। এই রেকর্ডের বাইরে কোনো কথা নেই। এ সম্পর্কেই সূরা কাহাফের ৪৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- ‘আর সে দিন আমলনামা সামনে রেখে দেয়া হবে। সে সময় তোমরা দেখবে অপরাধীরা নিজেদের জীবন খাতায় যা লেখা আছে সে জন্য ভীত হচ্ছে এবং তারা বলছে, হায় আমাদের দুর্ভাগ্য, এটি কেমন খাতা, আমাদের ছোট-বড় এমন কোনো কিছুই এখানে লেখা থেকে বাদ পড়েনি। তাদের যে যা কিছু করেছিল সবই নিজের সামনে উপস্থিত পাবে এবং তোমার রব কারোর প্রতি জুলুম করবেন না।’

আসলে প্রত্যেক মানুষের কর্মকাণ্ড আল্লাহ সরাসরি জানলেও আখিরাতে যখন তিনি আদালত কায়েম করবেন তখন সেখানে যাকেই শাস্তি দেবেন ইনসাফ ও ন্যায়নীতির দাবি পুরোপুরি পালন করেই শাস্তি দেবেন। তাই উল্লিখিত রেকর্ড ছাড়াও মহান আল্লাহ সে দিন মানুষের অঙ্গ-প্রতঙ্গগুলোকে স্বাধীনভাবে কথা বলার সুযোগ সৃষ্টি করে দেবেন। তাঁর আদালতে প্রত্যেকটি অপরাধী মানুষের বিরুদ্ধে যে মামলা দায়ের করা হবে তার সপক্ষে এমনসব সাক্ষ্য-প্রমাণ পেশ করা হবে যার ফলে তার অপরাধী হওয়ার ব্যাপারে কারো কোনো বলার অবকাশ থাকবে না। সর্বপ্রথম পেশ করা হবে তার আমলনামা। আমলনামার পাশাপাশি তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এই আমলানামার প্রতিটি বিষয়ের সাক্ষ্য দেবে।

আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আজ আমি এদের মুখ বন্ধ করে দিচ্ছি, এদের হাত আমার সাথে কথা বলবে এবং এদের পা সাক্ষ্য দেবে, এরা দুনিয়ায় কী উপার্জন করে এসেছে।’ (সূরা ইয়াসিন-৬৫) এখানে মুখ বন্ধ করার কথা বলা হয়েছে আবার সূরা নূরে মুখকে স্বাধীনভাবে কথা বলার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ মুখ স্বাধীনভাবে কথা বলবে যা সে করেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তারা যেন সে দিনের কথা ভুলে না যায় যে দিন তাদের নিজেদের কণ্ঠ ও তাদের নিজেদের হাত-পা তাদের কৃতকর্মের সাক্ষ্য দেবে।’ (সূরা নূর-২৪)
এখানে এ প্রশ্ন দেখা দেয়, এক দিকে আল্লাহ বলেন- আমি এদের কণ্ঠ রুদ্ধ করে দেবো এবং উল্লিখিত সূরা নূরের আয়াতে বলা হয়েছে যে, এদের কণ্ঠ সাক্ষ্য দেবে। এ দু’টি বক্তব্যের মধ্যে তাফসিরকারকরা সামঞ্জস্য বিধান করছেন এভাবে যে, তাদের কথা বলার ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হবে। অর্থাৎ এরপর তারা স্বেচ্ছায় নিজেদের মর্জিমাফিক কথা বলতে পারবে না।

আর কণ্ঠের সাক্ষ্যদান অর্থ হচ্ছে, পাপিষ্ঠ লোকেরা তাদেরকে কোন কোন কাজে লাগিয়েছিল, তাদের মাধ্যমে কেমন সব কুফরি কথা বলেছিল, কোন ধরনের মিথ্যা উচ্চারণ করেছিল, কত প্রকার ফিতনা সৃষ্টি করেছিল, কী কী কথা বলে মানুষের মধ্যে বিভেদের পাহাড় তৈরি করেছিল এবং কোন কোন সময় তাদের মাধ্যমে কোন কোন কথা বলেছিল সেসব বিবরণ তাদের কণ্ঠ স্বতঃস্ফূর্তভাবে দিয়ে যেতে থাকবে। অর্থাৎ মুখ তখন আর তার নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। এটিকে পূর্ণভাবে স্বাধীন করে দেয়া হবে এবং সে যা সত্য তা স্বতঃস্ফূতভাবে বলার শক্তি দেয়া হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘পরে যখন সবাই সেখানে পৌঁছে যাবে তখন তাদের কান, তাদের চোখ ও তাদের দেহের চামড়া তারা পৃথিবীতে কী করত সে সম্পর্কে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে।’ (সূরা হা-মিম আস সাজদা-২০)

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন- ‘তারা তাদের শরীরের চামড়াগুলোকে বলবে, তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলে কেন? তারা জবাব দেবে, সেই আল্লাহই আমাদের বাকশক্তি দান করেছেন যিনি প্রতিটি বস্তুকে বাকশক্তি দান করেছেন। তিনিই তোমাদেরকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলেন। আর এখন তোমাদেরকে তাঁর কাছেই ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পৃথিবীতে অপরাধ করার সময় তোমরা গোপন করতে তখন তোমরা চিন্তাও করোনি যে, তোমাদের নিজেদের কান, তোমাদের চোখ ও তোমাদের দেহের চামড়া কোনো সময় তোমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। তোমরা তো বরং মনে করেছিলে, তোমাদের বহুসংখ্যক কাজকর্মের খবর আল্লাহও রাখেন না।’ (সূরা হা-মিম আস সাজদা : ২১-২২)

এ থেকে আরো জানা গেল, সে দিন মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছাড়াও যেসব জিনিসের সামনে মানুষ কোনো কাজ করেছিল তার প্রতিটি জিনিসই কথা বলে উঠবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘পৃথিবী তার ভেতরকার সমস্ত ভার বাইরে বের করে দেবে। আর মানুষ বলবে, এর কী হয়েছে। সে দিন সে তার নিজের সব অবস্থার বর্ণনা করবে।’ (সূরা জিলজাল : ২-৪) হজরত আবু হুরায়রা রা: বর্ণনা করেছেন- রাসূল সা: এ আয়াতটি পড়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘জানো তার সেই অবস্থা কী?’ লোকেরা জবাব দিলো, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভালো জানেন। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘সেই অবস্থা হচ্ছে, জমিনের পিঠে প্রত্যেক মানব-মানবী যে কাজ করবে সে তার সাক্ষ্য দেবে। সে বলবে, এই ব্যক্তি অমুক দিন এই কাজ করেছিল। এই হচ্ছে সেই অবস্থা, যা জমিন বর্ণনা করবে।’ (মুসনাদে আহমাদ, তিরমিজি, নাসায়ি) এ ছাড়াও এই সাক্ষ্যের কথা আনাস রা:, আবু মূসা আশআরি রা:, আবু সাঈদ খুদরি রা: ও ইবনে আব্বাস রা: বিভিন্ন হাদিসে নবী সা: থেকে বর্ণনা করেছেন এবং মুসলিম, নাসায়িতে উল্লেখ রয়েছে।

তা ছাড়া প্রত্যেককে তার নিজের আমলনামা পড়তে দেয়া হবে, যাতে সে নিজের আমলনামা পড়ে সে নিজেই ফয়সালা দেয়ার জন্য যথেষ্ট হয়। অর্থাৎ বিচারক রায় শোনানোর প্রয়োজন হবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘পড়, নিজের আমলনামা, আজ নিজের হিসাব করার জন্য তুমি নিজেই যথেষ্ট।’ (সূরা বনি ইসরাইল-১৪)

লেখক :

  • জাফর আহমাদ

শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

আজকের সূর্যোদয়

আজকের সূর্যোদয় প্রত্রিকায় আপনাদের স্বাগতম। ‍আমাদের নিউজ পড়ুন এবং বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদের পাশে থাকুন।

বরিশালে মুজিবিয়ানের ৮৭ নেতাকে খুঁজছে গোয়েন্দা সংস্থা

রেকর্ড হচ্ছে প্রতিটি কথা ও কাজ

আপডেট সময় ১২:০১:৩২ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৩ নভেম্বর ২০২৩

এক দিকে স্বয়ং আল্লাহ নিজে সরাসরি মানুষের প্রতিটি গতিবিধি এবং চিন্তা ও কল্পনা সম্পর্কে অবহিত। অপর দিকে প্রত্যেক মানুষের জন্য দু’জন ফেরেশতা নিয়োজিত আছেন যারা তার প্রত্যেকটি তৎপরতা লিপিবদ্ধ করছেন। তার কোনো কাজ ও কথাই তাদের রেকর্ড থেকে বাদ পড়ে না। অর্থাৎ আল্লাহর আদালতে যে সময় মানুষকে পেশ করা হবে তখন কে কী করে এসেছে সে বিষয়ে আল্লাহ নিজ থেকেই অবহিত থাকবেন। তা ছাড়া সে বিষয়ে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য এমন দু’জন সাক্ষীও উপস্থিত থাকবেন যারা তার কাজকর্মের লিখিত নথিভুক্ত প্রমাণাদি এনে সামনে পেশ করবেন। লিখিত এ প্রমাণাদি কেমন ধরনের হবে তার সঠিক ধারণা করা আমাদের জন্য কঠিন। তবে আজ আমাদের সামনে যেসব সত্য উন্মোচিত হচ্ছে তা দেখে এ বিষয়টি একেবারে নিশ্চিত মনে হয় যে, যে পরিবেশে মানুষ অবস্থান ও কাজকর্ম করে তাতে চতুর্দিকের প্রতিটি অণু-পরমাণুর ওপর তার কণ্ঠস্বর, ছবি ও গতিবিধির ছাপ পড়ে যাচ্ছে। এসব জিনিসের প্রত্যেকটিকে পুনরায় হুবহু সেই আকার-আকৃতি ও স্বরে এমনভাবে পেশ করা যেতে পারে যে, আসল ও নকলের মধ্যে সামান্যতম পার্থক্যও থাকবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘এমন কোনো শব্দ তার মুখ থেকে বের হয় না যা সংরক্ষিত করার জন্য একজন সদা প্রস্তুত রক্ষক উপস্থিত থাকে না।’ (সূরা কাফ-১৮)

মানুষ যন্ত্রপাতির সাহায্যে এ কাজটি অত্যন্ত সীমিত মাত্রায় করছে। কিন্তু আল্লাহর ফেরেশতারা এসব যন্ত্রপাতিরও মুখাপেক্ষী নয়, এসব প্রতিবন্ধকতায়ও আবদ্ধ নয়। মানুষের নিজ দেহ এবং তার চার পাশের প্রতিটি জিনিস তাদের জন্য টেপ ও ফিল্ম-স্বরূপ। তারা এসব টেপ ও ফিল্মের ওপর প্রতিটি শব্দ এবং ছবি অতি সূক্ষ্ম ও খুঁটিনাটি বিষয়সহ অবিকল ধারণ করতে পারে এবং পৃথিবীতে ব্যক্তি যেসব কাজ করত কিয়ামতের দিন তাকে তার নিজ কানে নিজ কণ্ঠস্বরে সেসব কথা শুনিয়ে দিতে পারে, নিজ চোখে তার সব কর্মকাণ্ডের এমন জ্বলজ্যান্ত ছবি দেখিয়ে দিতে পারে যা অস্বীকার করা তার জন্য সম্ভব হবে না। প্রযুক্তির ক্রমোন্নতি এ সত্য দিন দিন সুস্পষ্ট হচ্ছে।
এখানে এ কথাটিও ভালোভাবে বুঝে নেয়া দরকার যে, আল্লাহ তায়ালা আখিরাতের আদালতে কোনো ব্যক্তিকে কেবল নিজের ব্যক্তিগত জ্ঞানের ভিত্তিতে শাস্তি দেবেন না; বরং ন্যায়বিচারের সমস্ত পূর্বশর্ত পূরণ করে তাকে শাস্তি দেবেন। এ কারণে দুনিয়াতেই প্রত্যেক ব্যক্তির সমস্ত কথা ও কাজের পূর্ণাঙ্গ রেকর্ড তৈরি করা হচ্ছে যাতে অনস্বীকার্য সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তার সমস্ত কর্মকাণ্ডের প্রমাণাদি পেশ করা যায়।

এ কথাটিকে আরো সুষ্ঠুভাবে সূরা ইনফিতারে বলা হয়েছে- ‘অথচ তোমাদের ওপর পরিদর্শক নিযুক্ত রয়েছে, এমন সম্মানিত লেখকবৃন্দ, যারা তোমাদের প্রত্যেকটি কাজ জানে।’ (আয়াত : ১০-১২) এটি পূর্বাপর আলোচনার অংশ। অর্থাৎ বলা হচ্ছে- মানুষ চাইলে কর্মফল দিবসকে অস্বীকার করতে পারে; কিন্তু এতে প্রকৃত সত্য বদলে যাবে না। প্রকৃত সত্য হচ্ছে এই যে, তাদের রব এই দুনিয়ায় তাদেরকে লাগামহীনভাবে ছেড়ে দেননি; বরং তিনি তাদের প্রত্যেকের ওপর অত্যন্ত সত্যনিষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত করে রেখেছেন। তারা নিরপেক্ষভাবে তাদের সমস্ত ভালো ও মন্দকাজ রেকর্ড করে যাচ্ছে। তাদের কোনো কাজ সম্মানিত তত্ত্বাবধায়কের অগোচরে থাকছে না। মানুষ অন্ধকারে, একান্ত নির্জনে, জনমানবহীন গভীর জঙ্গলে অথবা এমন যেকোনো অবস্থায় কোনো কাজ করে থাকলে যে সম্পর্কে মানুষ পূর্ণ নিশ্চিন্ত থাকছে যে, তা সব সৃষ্টির অগোচরে রয়ে গেছে, তারপরও তা তাদের কাছ থেকে গোপন থাকছে না। এই তত্ত্বাবধায়ক ফেরেশতাদের জন্য আল্লাহ ‘কিরামান কাতেবিন’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ লেখকবৃন্দ যারা কারিম। অত্যন্ত সম্মানিত ও মর্যাদাবান। তাদের কারোর সাথে ব্যক্তিগত ভালোবাসা বা শত্রুতা নেই। ফলে একজনের প্রতি অন্যায় পক্ষপাতিত্ব ও অন্যজনের প্রতি অযথা বিরোধিতা করে সত্যবিরোধী ঘটনা রেকর্ড করার কোনো অবকাশই সেখানে নেই। তারা খেয়ানতকারীও নয়। ডিউটি ফাঁকি দিয়ে নিজেদের তরফ থেকে খাতায় উল্টো-সিধে লিখে দেয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তারা ঘোষখোরও নয়। নগদ কিছু নিয়ে কারো পক্ষে বা কারো বিপক্ষে মিথ্যা রিপোর্ট দেয়ার কোনো প্রশ্নই তাদের ব্যাপারে দেখা দেয় না। এসব নৈতিক দুর্বলতা থেকে তারা মুক্ত। কাজেই সৎ ও অসৎ উভয় ধরনের মানুষের নিশ্চিত থাকা উচিত যে, তাদের প্রত্যেকের সৎকাজ হুবহু রেকর্ড করা হবে এবং কারোর ঘাড়ে এমন কোনো অসৎ কাজ চাপিয়ে দেয়া হবে না, যা সে করেনি।

তারপর এই আয়াতে এই ফেরেশতাদের দ্বিতীয় যে গুণটি বর্ণনা করা হয়েছে তা হচ্ছে- ‘তোমরা যা কিছু করো তা তারা জানে।’ অর্থাৎ, তাদের অবস্থা দুনিয়ার সিআইডি ও তথ্য সরবরাহ এজেন্সিগুলোর মতো নয়। সব রকমের প্রচেষ্টা ও সাধ্য-সাধনার পরও অনেক কথা তাদের কাছ থেকে গোপন থেকে যায়। কিন্তু এ ফেরেশতারা প্রত্যেক ব্যক্তির প্রত্যেকটি কথা ও কাজ সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত। সব জায়গায় সব অবস্থায় সব ব্যক্তির সাথে তারা এমনভাবে লেগে আছে যে, তারা জানতেই পারছে না, কেউ তাদের কাজ পরিদর্শন করছে। কোন ব্যক্তি কোন নিয়তে কী কাজ করেছে তাও তারা জানতে পারে। তাই তাদের তৈরি করা রেকর্ড একটি পূর্ণাঙ্গ রেকর্ড। এই রেকর্ডের বাইরে কোনো কথা নেই। এ সম্পর্কেই সূরা কাহাফের ৪৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- ‘আর সে দিন আমলনামা সামনে রেখে দেয়া হবে। সে সময় তোমরা দেখবে অপরাধীরা নিজেদের জীবন খাতায় যা লেখা আছে সে জন্য ভীত হচ্ছে এবং তারা বলছে, হায় আমাদের দুর্ভাগ্য, এটি কেমন খাতা, আমাদের ছোট-বড় এমন কোনো কিছুই এখানে লেখা থেকে বাদ পড়েনি। তাদের যে যা কিছু করেছিল সবই নিজের সামনে উপস্থিত পাবে এবং তোমার রব কারোর প্রতি জুলুম করবেন না।’

আসলে প্রত্যেক মানুষের কর্মকাণ্ড আল্লাহ সরাসরি জানলেও আখিরাতে যখন তিনি আদালত কায়েম করবেন তখন সেখানে যাকেই শাস্তি দেবেন ইনসাফ ও ন্যায়নীতির দাবি পুরোপুরি পালন করেই শাস্তি দেবেন। তাই উল্লিখিত রেকর্ড ছাড়াও মহান আল্লাহ সে দিন মানুষের অঙ্গ-প্রতঙ্গগুলোকে স্বাধীনভাবে কথা বলার সুযোগ সৃষ্টি করে দেবেন। তাঁর আদালতে প্রত্যেকটি অপরাধী মানুষের বিরুদ্ধে যে মামলা দায়ের করা হবে তার সপক্ষে এমনসব সাক্ষ্য-প্রমাণ পেশ করা হবে যার ফলে তার অপরাধী হওয়ার ব্যাপারে কারো কোনো বলার অবকাশ থাকবে না। সর্বপ্রথম পেশ করা হবে তার আমলনামা। আমলনামার পাশাপাশি তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এই আমলানামার প্রতিটি বিষয়ের সাক্ষ্য দেবে।

আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আজ আমি এদের মুখ বন্ধ করে দিচ্ছি, এদের হাত আমার সাথে কথা বলবে এবং এদের পা সাক্ষ্য দেবে, এরা দুনিয়ায় কী উপার্জন করে এসেছে।’ (সূরা ইয়াসিন-৬৫) এখানে মুখ বন্ধ করার কথা বলা হয়েছে আবার সূরা নূরে মুখকে স্বাধীনভাবে কথা বলার কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ মুখ স্বাধীনভাবে কথা বলবে যা সে করেছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তারা যেন সে দিনের কথা ভুলে না যায় যে দিন তাদের নিজেদের কণ্ঠ ও তাদের নিজেদের হাত-পা তাদের কৃতকর্মের সাক্ষ্য দেবে।’ (সূরা নূর-২৪)
এখানে এ প্রশ্ন দেখা দেয়, এক দিকে আল্লাহ বলেন- আমি এদের কণ্ঠ রুদ্ধ করে দেবো এবং উল্লিখিত সূরা নূরের আয়াতে বলা হয়েছে যে, এদের কণ্ঠ সাক্ষ্য দেবে। এ দু’টি বক্তব্যের মধ্যে তাফসিরকারকরা সামঞ্জস্য বিধান করছেন এভাবে যে, তাদের কথা বলার ক্ষমতা কেড়ে নেয়া হবে। অর্থাৎ এরপর তারা স্বেচ্ছায় নিজেদের মর্জিমাফিক কথা বলতে পারবে না।

আর কণ্ঠের সাক্ষ্যদান অর্থ হচ্ছে, পাপিষ্ঠ লোকেরা তাদেরকে কোন কোন কাজে লাগিয়েছিল, তাদের মাধ্যমে কেমন সব কুফরি কথা বলেছিল, কোন ধরনের মিথ্যা উচ্চারণ করেছিল, কত প্রকার ফিতনা সৃষ্টি করেছিল, কী কী কথা বলে মানুষের মধ্যে বিভেদের পাহাড় তৈরি করেছিল এবং কোন কোন সময় তাদের মাধ্যমে কোন কোন কথা বলেছিল সেসব বিবরণ তাদের কণ্ঠ স্বতঃস্ফূর্তভাবে দিয়ে যেতে থাকবে। অর্থাৎ মুখ তখন আর তার নিয়ন্ত্রণে থাকবে না। এটিকে পূর্ণভাবে স্বাধীন করে দেয়া হবে এবং সে যা সত্য তা স্বতঃস্ফূতভাবে বলার শক্তি দেয়া হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘পরে যখন সবাই সেখানে পৌঁছে যাবে তখন তাদের কান, তাদের চোখ ও তাদের দেহের চামড়া তারা পৃথিবীতে কী করত সে সম্পর্কে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে।’ (সূরা হা-মিম আস সাজদা-২০)

আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন- ‘তারা তাদের শরীরের চামড়াগুলোকে বলবে, তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলে কেন? তারা জবাব দেবে, সেই আল্লাহই আমাদের বাকশক্তি দান করেছেন যিনি প্রতিটি বস্তুকে বাকশক্তি দান করেছেন। তিনিই তোমাদেরকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলেন। আর এখন তোমাদেরকে তাঁর কাছেই ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পৃথিবীতে অপরাধ করার সময় তোমরা গোপন করতে তখন তোমরা চিন্তাও করোনি যে, তোমাদের নিজেদের কান, তোমাদের চোখ ও তোমাদের দেহের চামড়া কোনো সময় তোমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। তোমরা তো বরং মনে করেছিলে, তোমাদের বহুসংখ্যক কাজকর্মের খবর আল্লাহও রাখেন না।’ (সূরা হা-মিম আস সাজদা : ২১-২২)

এ থেকে আরো জানা গেল, সে দিন মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছাড়াও যেসব জিনিসের সামনে মানুষ কোনো কাজ করেছিল তার প্রতিটি জিনিসই কথা বলে উঠবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘পৃথিবী তার ভেতরকার সমস্ত ভার বাইরে বের করে দেবে। আর মানুষ বলবে, এর কী হয়েছে। সে দিন সে তার নিজের সব অবস্থার বর্ণনা করবে।’ (সূরা জিলজাল : ২-৪) হজরত আবু হুরায়রা রা: বর্ণনা করেছেন- রাসূল সা: এ আয়াতটি পড়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘জানো তার সেই অবস্থা কী?’ লোকেরা জবাব দিলো, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভালো জানেন। রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘সেই অবস্থা হচ্ছে, জমিনের পিঠে প্রত্যেক মানব-মানবী যে কাজ করবে সে তার সাক্ষ্য দেবে। সে বলবে, এই ব্যক্তি অমুক দিন এই কাজ করেছিল। এই হচ্ছে সেই অবস্থা, যা জমিন বর্ণনা করবে।’ (মুসনাদে আহমাদ, তিরমিজি, নাসায়ি) এ ছাড়াও এই সাক্ষ্যের কথা আনাস রা:, আবু মূসা আশআরি রা:, আবু সাঈদ খুদরি রা: ও ইবনে আব্বাস রা: বিভিন্ন হাদিসে নবী সা: থেকে বর্ণনা করেছেন এবং মুসলিম, নাসায়িতে উল্লেখ রয়েছে।

তা ছাড়া প্রত্যেককে তার নিজের আমলনামা পড়তে দেয়া হবে, যাতে সে নিজের আমলনামা পড়ে সে নিজেই ফয়সালা দেয়ার জন্য যথেষ্ট হয়। অর্থাৎ বিচারক রায় শোনানোর প্রয়োজন হবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘পড়, নিজের আমলনামা, আজ নিজের হিসাব করার জন্য তুমি নিজেই যথেষ্ট।’ (সূরা বনি ইসরাইল-১৪)

লেখক :

  • জাফর আহমাদ

শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট