যৌবন মানবজীবনের অনন্য সাধারণ গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। যৌবনেই বপিত হয় ব্যক্তির দুনিয়াবি ও পরকালীন সফলতার বীজ। কিয়ামতে আল্লাহ তায়ালা যৌবনকালের পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব নেবেন। সাহাবি ইবনে মাসউদ রা: বলেন, কিয়ামতে যে চারটি বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত না হওয়া পর্যন্ত বান্দা তার উভয় পা নড়াচড়া করতে পারবে না। তার অন্যতম হলো- যৌবনকাল কোথায় কোন কাজে ব্যয় করেছে। (মিজানুল ইতেদাল-৩ : ২১) যৌবনের প্রতিটি কাজ ও পদক্ষেপ পূর্ণ সতর্কতা ও সাবধানতার সাথে করা উচিত। নচেৎ অযাচিত পদস্খলনের হিসেবে থমকে যেতে হবে রবের দরবারে।
যৌবনের গুরুত্ব : যৌবন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি নিয়ামত। যা ব্যক্তি জীবনের স্বর্ণালি সময়। এ সময় মানুষের ইবাদতের শক্তি ও সুস্থতা দুটোই থাকে। যৌবনকালে যতটা শুদ্ধতা ও দৃঢ়তার সাথে কাজ করা যায়, অন্য কোনো সময় সেটি সম্ভব হয় না। তাই, নবীজী যৌবনের গুরুত্ব দিতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, পাঁচটি বিষয়ের সম্মুখীন হওয়ার আগেই অন্য পাঁচটি বিষয়কে গণিমত মনে করে গুরুত্ব দেয়া- যৌবনকে বার্ধক্যের আগে, সুস্থতাকে অসুস্থতার আগে, সচ্ছলতাকে অসচ্ছলতার আগে, অবকাশকে ব্যস্ততার আগে এবং জীবনকে মৃত্যুর আগে। (বায়হাকি-১০২৪৮) যৌবনের গুরুত্ব এতটাই যে, আল্লাহ তায়ালা নবী এবং আলেমদের যৌবনকালেই নবুওয়তি ও ইলম দান করে থাকেন। (মুজামুল আওসাত-৬ : ২৮৩)
যৌবনকালের ইবাদত : ইবাদত বান্দাকে রবের নৈকট্যশীল করে। মর্যাদাকে সমুন্নত করে। যৌবনের ইবাদতকে আল্লাহ তায়ালা বড় ভালোবাসেন। নবীজী বলেন, আল্লাহ তায়ালা ইবাদতকারী যুবকদের ব্যাপারে ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করেন। তিনি বলেন, ‘হে যুবক! তোমরা যারা আমার জন্য প্রবৃত্তিকে বিসর্জন দিয়েছে। যৌবনকে আমার জন্য ব্যয় করেছ। তোমরা আমার কাছে পুণ্যবান ফেরেশতার মতো।’ (তাখরিজুল ইহইয়া-১ : ৩১১)
আল্লাহর বিস্ময় : যে যুবক যৌবনে প্রবৃত্তি, মনবাসনা ত্যাগ করে আল্লাহর ইবাদতে লিপ্ত হয়, আল্লাহ তায়ালা তার প্রতি বিস্মিত হন। নবীজী বলেন, ‘আপনার রব সেই যুবকের প্রতি বিস্ময় ও সন্তুষ্ট যার মধ্যে প্রবৃত্তির চাহিদা-বাসনা ও শিশুসুলভ আচরণ নেই।’ (মুসনাদে আহমাদ-১৭৩৭১)
আল্লাহর ভালোবাসার যুবক : আল্লাহর ইবাদতে যৌবন অতিবাহিতকারী যুবককে তিনি ভালোবাসেন। হাদিসে এসেছে, নবীজী সা: বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা সেই যুবককে ভালোবাসেন যে তার যৌবনকে আল্লাহর ইবাদতে অতিবাহিত করে।’ (হিলয়াতুল আউলিয়া-৫ : ৩৯৪) কিয়ামতের কঠিন সময়ে, যখন আল্লাহ তায়ালার আরশের ছায়া ব্যতীত কোনো ছায়া থাকবে না। সেই ছায়া আশ্রয় গ্রহণকারীদের অন্যতম হবেন সেই যুবক যে আল্লাহর ইবাদতে নিজ যৌবনকে ব্যয় করেছে।’ (বুখারি-৬৬০) যুবকদের উচিত খেল-তামাশায় যৌবনের মূল্যবান সময় নষ্ট না করে আল্লাহ তায়ালার ইবাদত করা। যাতে আরশের ছায়ায় আশ্রয় পাওয়া যায়।
তাওবাকারী যুবক : তাওবা বান্দার গোনাহকে মোচনকারী। এর মাধ্যমে আল্লাহ তায়ালা বান্দার পাপ মার্জনা করেন। যেকোনো বয়সের বান্দার তাওবাই আল্লাহ তায়ালা পছন্দ ও কবুল করেন। কুরআনে এসেছে- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা তাওবাকারীদের পছন্দ করেন।’ (সূরা বাকারা-২২২) তবে যুবকদের তাওবাকে আল্লাহ তায়ালা খুব বেশি মহব্বত করেন। হাদিসে এসেছে, নবীজী বলেছেন, ‘তাওবাকারী যুবক আল্লাহ তায়ালার কাছে অধিক প্রিয়।’ (মিজানুল ইতেদাল-৩ : ৩৩৫)
ইসলামের জন্য উৎসর্গিত যৌবন : যে যুবক তার যৌবনকে ইসলামের জন্য উৎসর্গ করবে, কিয়ামতে আল্লাহর পক্ষ থেকে তার জন্য নূর থাকবে। কাব ইবনে মুররা বলেন, নবীজী সা: বলেছেন, ‘যে যুবক মুসলিম অবস্থায় বৃদ্ধ হয়, কিয়ামতে তার জন্য একটি বিশেষ আলো থাকবে।’ (তিরমিজি-১৬৩৪) অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মোক্ষম সময় যৌবনকাল। হজরত ইবরাহিম আ: যৌবনে একাই মূর্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা করেছিলেন। মানুষের কাছে পৌঁছিয়েছিলেন একত্ববাদের পয়গাম। উপেক্ষা করেছিলেন সবার চোখ রাঙানি। একমাত্র আল্লাহকে সঙ্গী করে, যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন সব তাগুতের বিপক্ষে। তার যৌবনের সেই বিবরণ কুরআনে এসেছে- ‘তারা বলল, একজন যুবককে তাদের আলোচনা করতে আমরা শুনেছি। যার নাম ইবরাহিম।’ (সূরা আম্বিয়া-৬০) হেলায়-খেলায়, অহেতুক যৌবনকে না কাটিয়ে রব ও ইসলামের জন্য বিসর্জন দিয়েছেন।
যৌবনের ঈমান ব্যক্তিকে নির্ভীক করে : যৌবনকালের ঈমান ব্যক্তিকে নির্ভীকতার শিক্ষা দেয়। হিজরতের রাতে যেমন নির্ভীক ছিলেন হজরত আলী রা:। ঘরের বাইরে ৭০ জন যুবক উন্মুক্ত তরবারি নিয়ে দাঁড়ানো থাকা সত্ত্বেও তিনি নবীজীর বিছানায় শুয়ে ছিলেন নিশ্চিন্ত মনে। (তারবিয়্যাতুল ইসলামিয়া লিশ-শাবাব) সাধারণত যারা বয়স ও অভিজ্ঞতায় পরিপক্ব হয়, তাদের পা ভয়ও সম্ভাবনার শেকলে বাঁধা থাকে। কিন্তু তরুণ ও যুবকরা এই অদৃশ্য শিকল থেকে মুক্ত হয়। যেকোনো সংস্কারমূলক আন্দোলন, ঈমান ও ইসলামের ডাকে সাড়া দিতে পারে দ্বিধাহীন চিত্তে। যেমন ঈমানের ডাকে সাড়া দিয়েছিল আসহাবে কাহাফের সাত যুবক। নিজেদের ঈমানের কথা ঘোষণা করেছিলেন দ্ব্যর্থ কণ্ঠে। নিজেদের ঈমান বাঁচাতে আশ্রয় নিয়েছিলেন গুহা অভ্যন্তরে। আল্লাহ তায়ালার সাহায্য এসেছিল তাদের জন্য। কুরআনে এসেছে- ‘তারা ছিল কয়েকজন যুবক। যারা তাদের প্রতিপালকের প্রতি ঈমান এনেছিল এবং আমি তাদের সৎপথে চলার শক্তি বৃদ্ধি করেছিলাম।’ (সূরা কাহাফ-১৩)
যৌবনের তমসা : যৌবন শব্দটির মধ্যে এক ধরনের আন্দোলন, উদ্যমতা আর পাগলামি আছে। যৌবনের নিজস্ব উষ্ণতা আছে। যদি ঈমানের শীতলতা দিয়ে তা নিবারণ করা না হয়, তাহলে তাকে কুপথে পরিচালিত করবে। নবীজী সা: বলেছেন, ‘যৌবন পাগলামির একটি শাখা আর নারী শয়তানের রশি।’ (ইতেদালুল কুলুব-১৯৮) সাধারণত যৌবনেই ছেলেমেয়েরা বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িত হয়। তাই যুবাদেরকে সব ধরনের বেহায়াপনা, বেলাল্লাপনা, অশ্লীলতা আর অপরাধ থেকে থেকে বেঁচে রাখা এবং বেঁচে থাকার শিক্ষা ও দীক্ষা দেয়া রাষ্ট্র ও পরিবারের দায়িত্ব। ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করা।
ব্যভিচারে না জড়ানোয় রাসূলের নির্দেশ : এই বয়সে ছেলেমেয়েরা অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে এবং এই স¤পর্ক তাদেরকে ব্যভিচার পর্যন্ত নিয়ে যায়। যা অত্যন্ত গর্হিত ও অশ্লীল কাজ। মুসলিম কোনো যুবক এতে সম্পৃক্ত হতে পারে না। রাসূল সা: বলেছেন, ‘ব্যভিচারী ব্যক্তি ব্যভিচারবস্থায় মুমিন থাকে না।’ (বুখারি-২৪৭৫) ব্যভিচার মুক্ত যুবাদের নবীজী সা: জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছেন। রাসূল সা: কুরাইশের যুবকদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘হে কুরাইশের যুবকরা! তোমরা ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ো না। যে ব্যক্তি তার যৌবনকে নিরাপদ রাখবে, তার জন্য জান্নাত রয়েছে।’ (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ-৪ : ২৫৬)
ব্যভিচার থেকে বাঁচার উপায় : আমাদের যুবসমাজ ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো তাদের বিয়ে বিলম্বিত করা। বর্তমান সমাজ যুবক-যুবতীদের বিয়েকে কঠিন করছে আর অনৈতিক সম্পর্ককে সহজ করেছে। অথচ রাসূল সা: বিয়েকে সহজ করতে বলেছেন। বিয়ের ন্যূনতম সামর্থ্য থাকলে বিয়ে করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি বলেন, ‘হে যুবকরা তোমরা যারা সামর্থ্য রাখো তারা বিয়ে করো। কেননা, তা দৃষ্টিকে অবনতকারী, লজ্জাস্থানকে হিফাজতকারী।’ (বুখারি-১৯০৫) এমনিভাবে নেশাজাতীয় বিষয়াদি থেকেও যুবাদের বেঁচে থাকা দরকার। ‘নেশাদ্রব্য সেবনবস্থায়ও ব্যক্তি মুমিন থাকে না।’ (বুখারি-২৪৭৫) রাসূল সা: এবং সাহাবিদের জীবনাদর্শই হবে মুসলিম যুবকদের আদর্শ ও চলার পাথেয়। কালের আবহে গা ভাসিয়ে না দিয়ে বরং কালকেই নিজের আবহে ভাসানোর চেষ্টা করতে হবে। কবির ভাষায়- কালের চালেই চলবে যদি, তাতে কী আর গর্ব আছে! যুগের গতি দেয় ঘুরিয়ে গর্ব তো ভাই তাকেই সাজে।
লেখক :
- শাহাদাত হোসাইন
শিক্ষা পরিচালক, ভরসা মাদরাসা, রংপুর