কুরআন মাজিদের বিশাল অংশজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আল্লাহ তায়ালার নানাবিধ নিয়ামতরাজির বিস্তারিত বিবরণ। আল্লাহ তায়ালা মানবজাতিকে সর্বোত্তম আকৃতিতে সৃষ্টি করে তাদেরকে অসংখ্য অগণিত নিয়ামতরাজি দান করেছেন। পৃথিবীর সব মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেও সেসব নিয়ামতরাজি গণনা করে শেষ করতে পারবে না। এসব নিয়ামতের মধ্যে অন্যতম একটি ‘সুসন্তান’। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘আল্লাহ তোমাদেরই মধ্য থেকে তোমাদের জন্য স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের স্ত্রীদের থেকে তোমাদের জন্য পুত্র পৌত্রাদি সৃষ্টি করেছেন। আর ভালো-ভালো জিনিসের থেকে রিজিকের ব্যবস্থা করেছেন; তবুও কি তারা ভিত্তিহীন জিনিসের প্রতি ঈমান রাখবে আর আল্লাহ তায়ালার নিয়ামতসমূহের অকৃতজ্ঞতা করবে’ (সূরা নাহল-৭২)? মানবশিশু মানবজাতির অতীব গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শিশুরা নিষ্পাপ, শিশু পবিত্রতার প্রতীক। শৈশবেই মানুষের জীবনের গতিপথ নির্ধারিত হয়। তাই ইসলাম শৈশবকালকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। তাই প্রতিটি মা-বাবার উচিত আপন আপন সন্তানদেরকে শৈশবকাল থেকেই ইসলামী ভাবধারায় গড়ে তোলা। এখানে সন্তান লালন-পালনের আলোচনা তুলে ধরা হলো-
আজান ইকামত : সন্তান জন্মের পর তার ডান কানে আজান ও বাম কানে ইকামত দেয়া। এ ব্যাপারে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে- হাসান রা: জন্মের পর রাসূলুল্লাহ সা: নামাজের আজান-ইকামতের মতো তার ডান কানে আজান ও বাম কানে ইকামত দিলেন’ (তিরমিজি-১/২৭৮)।
সুন্দর নাম রাখা : সন্তান জন্মের সাত দিনের মাথায় তার জন্য সুন্দর অর্থবহ একটি নাম রাখা। এ প্রসঙ্গে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। হজরত রাসূলুল্লাহ সা: শিশু জন্মের সাত দিনের মাথায় তার নাম রাখার নির্দেশ দিয়েছেন’ (আবু দাউদ-২/৩৬)।
আকিকা করা : সম্ভব হলে শিশু জন্মের সাত দিনের মাথায় তার আকিকা করা। আর সম্ভব না হলে, ১৪ কিংবা ২১ দিনের ভেতরে আকিকা করা। এ প্রসঙ্গে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হজরত রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘প্রত্যেক শিশু তার আকিকার সাথে বন্ধক। তাই জন্মের সাত দিনের মাথায় তার আকিকা করা এবং মাথা কামিয়ে দেয়া ও তার নাম রাখা’(ইবনে মাজা, পৃষ্ঠা-২২৮)।
সন্তানকে আদর করা ও চুমু খাওয়া : ছোট ছোট ফুলকলি শিশুসন্তানদেরকে আদর-যতœ করা এবং তাদেরকে মাঝে মধ্যে চুমু খাওয়া। রাসূলুল্লাহ সা: সন্তানদেরকে আদর করতেন ও চুমু খেতেন। এ প্রসঙ্গে এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা রা: সূত্রে বর্ণিত- ‘রাসূলুল্লাহ সা: একদিন হাসান ইবনে আলীকে চুমু খেলেন, সেখানে আকরা ইবনে হাবিস রা: ছিলেন, তিনি বললেন, আমার ১০টি সন্তান আছে, আমি কখনো তাদেরকে চুমু খাইনি। রাসূলুল্লাহ সা: তার দিকে তাকিয়ে বললেন, যে দয়া করে না; তার ওপর দয়া করা হয় না’ (বুখারি-১৮০৮)।
সন্তানকে কোলে নেয়া : রাত-দিনের চক্রাকারে মাঝে মধ্যে সন্তানকে কোলে নেয়া। রাসূলুল্লাহ সা: নিজ সন্তান ও অন্য শিশুদেরকেও মাঝে মধ্যে কোলে নিতেন। এ প্রসঙ্গে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। উম্মুল কায়েস বিনতে মিহসান তার এমন একজন ছোট সন্তান নিয়ে রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে এলেন, যে তখনো খাবার খেতে শিখেনি। রাসূলুল্লাহ সা: শিশুটিকে তাঁর কোলে বসালেন, তখন সে তাঁর কাপড়ে প্রস্রাব করে দিলো। রাসূলুল্লাহ সা: পানি আনিয়ে তার ওপর ছিটিয়ে দিলেন; ধৌত করলেন না’ (বুখারি-২২৩)।
দ্বীন-ইসলাম ও দ্বীনি মেজাজ শিক্ষা দেয়া : আমাদের যাপিত জীবনে যত ভালো ও নেক কাজ করি না কেন তাতে আমাদের কলিজার টুকরো সন্তানদেরও শরিক রাখা জরুরি। আমি দান-সদকা করলে বা সালাত-সিয়াম পালন করলে তাতে সন্তানকে শরিক রাখা দরকার। অনুরূপভাবে ইসলামের যেকোনো কাজে বা জনসেবামূলক কর্মকাণ্ডেও সন্তানকে শরিক রাখা ভালো। আমল-আখলাক, আদব ও ইবাদত ইত্যাদি সব ভালো কাজে ও শিক্ষা-দীক্ষায় সন্তানকে সাথে রাখলে এর সুফল দুনিয়াতেও মিলবে, পরকালেও মিলবে। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে- ‘স্মরণ করুন ওই সময়ের কথা, যখন ইবরাহিম বাইতুল্লাহর ভিত উঁচু করছিল এবং ইসমাইলও (তাঁর কাজে শরিক ছিল এবং তাঁরা বলছিল) হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের পক্ষ থেকে এ সেবা কবুল করুন। নিশ্চয়ই আপনি এবং কেবল আপনিই সব কিছু শোনেন ও সব কিছু জানেন’ (সূরা বাকারা-১২৭)। একটু ভাবুন, ইবরাহিম আ: কাবা শরিফ নির্মাণকাজে আপন পুত্র ইসমাইল আ:-কে কীভাবে শরিক রেখেছিলেন!
অন্য দিকে লোকমান আ: তাঁর পুত্রকে নামাজ ও ইসলামের মৌলিক কিছু বিষয় শিক্ষা দিতে বললেন। যেমন, ‘হে বৎস! সালাত কায়েম করো, মানুষকে সৎকাজের আদেশ করো, মন্দ কাজে বাধা দাও এবং তোমার যে কষ্ট দেখা দেয়, তাতে সবর করো। নিশ্চয়ই এটি অনেক হিম্মতের কাজ’ (সূরা লোকমান-১৭)। এভাবে অনেক হাদিস থেকেই উপরিউক্ত বিষয়টি প্রতীয়মান হয়। হজরত ওমর ইবনে আবু সালামাহ রা: বলেন, আমি রাসূল সা:-এর তত্ত্বাবধানে ছিলাম। খাবার পাত্রে আমার হাত চারপাশে ঘুরত। তিনি বললেন বালক! তুমি বিসমিল্লাহ বলে খাও, তোমার ডান হাতে খাও এবং নিজের সম্মুখ থেকে খাও’ (মুসলিম-৫১৬৪)।
অন্য এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হাসান ইবনে আলী রা: একবার একটি সদকার খেজুর মুখে দিলেন, তখন রাসূল সা: তাকে বললেন, ‘এটি ফেলে দাও। তুমি কি জানো না আমাদের জন্য সদকার মাল হারাম’ (বুখারি-৩০৭২)? উপরিউক্ত আয়াত ও হাদিস থেকে বোঝা যায়, পিতা-মাতার জন্য আপন সন্তান-সন্ততিকে শৈশবকাল থেকেই সালাত ও ইসলামের মৌলিক সব আমল শিক্ষা দেয়া আবশ্যক। একজন খোদাভীরু সফল মুমিন বানানোও আবশ্যক। কারণ, এর প্রভাব সন্তানের ওপর প্রতিফলিত হয়। আর তাই এটি শুধু একটি দায়িত্বই নয়; বরং একটি ইবাদতও।
লেখক :
- মুফতি আইয়ুব নাদীম
মুহাদ্দিস, জামিয়া কাশেফুল উলুম (হাটখোলা মাদরাসা) মধুপুর, টাঙ্গাইল