ঢাকা , মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

‘কলম’ শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার

  • সূর্যোদয় ডেস্ক:
  • আপডেট সময় ১২:০১:২৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩
  • ১১০৮ বার পড়া হয়েছে

মানব সৃষ্টির পর মানুষের শিক্ষার প্রসঙ্গটি উল্লিখিত হয়েছে। কারণ, শিক্ষাই মানুষকে অন্যান্য জীবজন্তু থেকে স্বতন্ত্র এবং সৃষ্টির সেরা রূপে চিহ্নিত করে। শিক্ষার পদ্ধতি সাধারণত দ্বিবিধ- ১. মৌখিক শিক্ষা এবং ২. কলম ও লেখার মাধ্যমে শিক্ষা। পবিত্র কুরআনুল কারিমের সূরা আলাকের শুরুতে ইকরা শব্দের মধ্যে মৌখিক শিক্ষা রয়েছে। কিন্তু ওই সূরার চতুর্থ আয়াতে শিক্ষাদান সম্পর্কিত বর্ণনায় কলমের সাহায্যে শিক্ষাকেই অগ্রে বর্ণনা করা হয়েছে।

কলম হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত একটি বড় নিয়ামত। যারা কলমকে সত্য ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে তারা দুনিয়াতে হাজার বছর বেঁচে থাকেন। কলম না থাকলে পৃথিবীতে কোনো কিছুই প্রতিষ্ঠিত হতো না। দুনিয়ার কায়-কারবারও সঠিকভাবে পরিচালিত হতো না। দয়াময় প্রভু মানবজাতিকে অপরূপ সৌন্দর্য দিয়ে বৈচিত্র্যময় করে সৃষ্টি করে তাদের হাতে কলম উঠিয়ে দিয়েছেন। আর এ কলমের সাহায্যেই তারা শিক্ষা, সভ্যতা, সংস্কৃতি, প্রগতি, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, তথ্যপ্রযুক্তি লিখে দিন দিন আধুনিকতার চরম উন্নতির শিখরে আরোহণ করছে। কলমকে বলা হয় হৃদয়ের জিহ্বা, জড় জগতের সবচেয়ে সম্মানী বস্তু। মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠত্বের দিক দিয়ে এটি অদ্বিতীয় ও অতুলনীয়। এর শক্তি অপরিসীম। এটি এক প্রচণ্ড দ্রোহ, শাণিত কৃপাণ, অসত্যের বিরুদ্ধে এক বজ্রকঠিন হাতিয়ার। টেইলর বলেছেন, ‘কলম হলো যন্ত্রপাতির মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক। এটি তরবারির চেয়েও ধারালো, চাবুক বা লোহার ডাণ্ডার চেয়েও ভয়াবহ।’
রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা যখন আদিকালে সব কিছু সৃষ্টি করেন, তখন আরশে তাঁর কাছে রক্ষিত কিতাবে এ কথা লিপিবদ্ধ করেন, আমার রহমত আমার ক্রোধের উপর প্রবল থাকবে। হাদিসে আরো বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করেন এবং তাকে লেখার নির্দেশ দেন। সে মতে কলম কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু হবে, সব লিখে ফেলে। এ কিতাব আল্লাহর কাছে আরশে রক্ষিত আছে’ (কুরতুবি)।

সূরা আলাকের চতুর্থ আয়াতে আছে কলমের সাহায্যে শিক্ষাদানের বর্ণনা। আর পঞ্চম আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রকৃত শিক্ষাদাতা আল্লাহ তায়ালা। তাঁর শিক্ষার মাধ্যমে অসংখ্য, অগণিত শুধু কলমের মধ্যেই সীমিত নয়। তাই বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে আগে জানত না। এতে কলম অথবা অন্য কোনো উপায় উল্লেখ না করার মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালার এ শিক্ষা মানুষের জন্মলগ্ন থেকে অব্যাহত রয়েছে।

আল্লাহ বান্দাদেরকে অজ্ঞাত বিষয়সমূহের জ্ঞানদান করে ধন্য করেছেন এবং তাদেরকে মূর্খতার অন্ধকার থেকে জ্ঞানের আলোর দিকে টেনে নিয়ে এসেছেন। তিনি মানুষকে লিখন বিদ্যার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। কেননা, যাবতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান, পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের ইতিহাস, জীবনালেখ্য ও উক্তি, আল্লাহ তায়ালার অবতীর্ণ কিতাবসমূহ যাবতীয় বিষয়াদিই কলমের সাহায্যে লিখিত হয়েছে এবং পৃথিবীর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অক্ষয় হয়ে থাকবে। কলম সৃজিত না হলে ইহকাল ও পরকালের সব কাজ কর্মেই বিঘিœত হতো।

কলমের একটি মাত্রই কাজ; আর তা হলো লেখা। চার্লস গ্রভিল বলেছেন, ‘একটি কলমের সাহায্যে যেভাবে হৃদয়ের কথা উৎসারিত হয়, তেমনি আর কিছুতেই হয় না।’ যিনি কলমের সাহায্যে সমাজের যাবতীয় অন্যায়, অত্যাচার-অবিচার, জুলুম-অনাচার ও নির্যাতন-নিপীড়ন দূর করতে চান তাকে হতে হয় সত্যের পক্ষে অকুতোভয় সৈনিক। তাকে মোকাবেলা করতে হয় নিদারুণ দুঃখ-মুসিবত, চলতে হয় নিঃসীম অন্ধকার পথে-ঢাকনাবিহীন ম্যানহোলের ওপর দিয়ে, পার হতে হয় কাঁটাবনের ঠিক মাঝখান দিয়ে, বন্ধু করে নিতে হয় ক্ষুধা-দারিদ্র্য আর অভাব-অনটনকে। পৃথিবীর বড় কলম সৈনিকদের জীবনেতিহাস পাঠ করলে আমাদের সামনে উপরিউক্ত চিত্রগুলোই ফুটে উঠে। আল্লামা ইকবাল, জর্জ বার্নাড শ, কাজী নজরুল ইসলাম, ইমাম গাজ্জালি, ইবনে তাইমিয়া, আল ফারাবি, শেখ সাদী প্রমুখের সংগ্রামী জীবন এবং তাদের ক্ষুরধার লেখনীই বিশ্ব সভ্যতাকে অজ্ঞতার তিমির থেকে টেনে তুলে আলোর সোনালি দিগন্তে নিয়ে আসে। যে কলম দেশাত্মবোধ, মানবতা, উদারতা, মহানুভবতা প্রতিভার বিকাশ সাধন করে মানুষের সঠিক পরিচয় তুলে ধরে প্রভুর সাথে যথাযথ সম্পর্ক তৈরি করে দিতে পারে না, সে কলম ধারালো কলম নয়; সে কলম ভোঁতা কলম, অকেজো কলম।

যে কলম বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা করে তামাম দুনিয়ার মানুষকে শান্তির সামিয়ানায় এনে দাঁড় করায়। যে কলম নির্যাতিত, নিপীড়িত, অবহেলিত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, ক্ষুধার্ত, সর্বহারা, দিশেহারা ও হতাশাগ্রস্তদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে; সে কলমই নৈতিক কলম, কল্যাণকামী কলম, সংগ্রামী কলম। আর এ কলমই সমাজের বিনির্মাণের শাণিত হাতিয়ার, এমন এক সম্মোহনী শক্তি যার শক্তি হাজারো তরবারি থেকেও ধারালো। কলমকে যদি প্রকৃতির ভাষা হিসেবে নিরূপণ করা যায় তাহলে এর সাহায্যে প্রকৃত শৈল্পিক সৌন্দর্য ফুটে উঠবে।

জ্ঞানী সম্প্রদায় বলেন, ‘জগতে তিনটি কলম আছে- ১. আল্লাহ তায়ালার কুদরতি হস্তে সৃজিত কলম : একে তিনি তাকদির লেখার কাজে আদেশ করেছিলেন; ২. ফেরেশতাদের কলম : যা দ্বারা তারা ভবিতব্য ঘটনা, তার পরিণাম ও মানুষের আমলনামা লিপিবদ্ধ করেন; ৩. সাধারণ মানুষের কলম : যা দিয়ে তারা নিজেদের কথাবার্তা, অর্জিত জ্ঞান, ভাবাবেগ, চিত্ত চেতনার কথা লিখে এবং নিজেদের অভীষ্ট কাজে ব্যবহার করে।’ লিখন প্রকৃতপক্ষে এক প্রকার বর্ণনা এবং বর্ণনা মানুষের এক বিশেষ গুণ যা আল্লাহপাক প্রদত্ত। প্রখ্যাত তাফসিরবিদ মোজাহিদ আবু আমের বলেন, ‘মহান আল্লাহপাক চারটি বস্তু স্বীয় কুদরতি হস্তে সৃষ্টি করেছেন। এ চার বস্তু ব্যতীত সমগ্র সৃষ্টিজগৎ ও বস্তুসমূহ ‘কুন’- তথা হয়ে যাও আদেশের দ্বারা সৃষ্টি করেছেন।

আল্লাহর স্বহস্তে সৃজিত চারটি বস্তু হলো- কলম, আরশ, জান্নাতুল আদন ও হজরত আদম আ:।

মনীষীরা বলেছেন, ‘বিদ্বানের কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও পবিত্র’। তাই কলমকে বানাতে হবে সত্যের প্রতিষ্ঠা আর মিথ্যা বিতাড়নের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার হিসেবে। ন্যায়ের পক্ষে আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে এটি হবে ধারালো অস্ত্র। নীতির প্রতিষ্ঠা আর দুর্নীতি নির্মূলকরণের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। এ কলমই পারে মননশীল সাহিত্য রচনার মাধ্যমে জাতিকে অনেক বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখাতে, দেশাত্মবোধ জাগ্রত করে দেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে।

আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না’ (সূরা আলাক : ৪-৫)। রাসূল সা: বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা যখন আদিকালে সব কিছু সৃষ্টি করেন, তখন আরশে তার কাছে রক্ষিত কিতাবে এ কথা লিপিবদ্ধ করেন যে, আমার রহমত আমার ক্রোধের উপর প্রবল থাকবে।’ ইবনে মুবারক রহ: বলেন, ‘সত্যিকার জ্ঞানী হতে হলে সর্বদা নিজকে জ্ঞান অন্বেষণে মগ্ন রাখতে হবে। আর যে নিজকে জ্ঞানী ভেবে নেয় সে প্রকৃত জ্ঞানী নয়, সে মূর্খ।’ হজরত ঈসা আ: বলেন, ‘অসৎ জ্ঞানীর উপমা সেই পাথরের মতো যেটি ঝরনার মুখে পড়ে পানির প্রবাহ বন্ধ করে দেয়; সে নিজেও পানি পান করে না এবং শস্যক্ষেতেও পানি যেতে দেয় না।’ হজরত সুফিয়ান সওরি রহ: বলেন, ‘এলেম চিৎকার করে আমলের আহ্বান জানায়, তার দাবি এ আহ্বানে সাড়া দিলে এলেম থাকে, অন্যথায় বিদায় নিয়ে চলে যায়।’ আর কলমই হলো জ্ঞান লিখার একমাত্র মাধ্যম।

বর্তমান পৃথিবীতে যাদের কলমের জোর বেশি তারাই শক্তিশালী। বিশ্ব চলে তাদের দাপটে, পৃথিবীকে মেনে নিতে হয় তাদের কর্তৃত্ব। এক সময় মুসলমানদের কলমের শক্তি ছিল প্রবল। তারা তাদের কলমের আঁচড়ে সারা পৃথিবীকে আলোয় আলোকিত করে তুলেছিলেন। তাদের দোয়াতের কালিতে লেখা হয়েছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সবগুলো অধ্যায়। অধুনা পৃথিবী আজো শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে তাদের গৌরবগাথা, কৃতিত্বের কথা, তাদের ক্ষুরধার লেখনীর কথা। কেননা, তাদের কলমের ধারালো লেখনীই পৃথিবীকে করে তুলেছে উদ্ভাসিত ও দীপ্তিময়। এভাবে যতদিন মুসলমানদের হাতে কলম ছিল ততদিন পৃথিবীবাসী তাদের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিল। আর এখন তারা কলম ছুড়ে ফেলে দিয়ে ভোগ-বিলাস আর আরাম-আয়েশের জিন্দেগি শুরু করার মাধ্যমে নিজেদের ললাটে অপমান আর জিল্লতির কলঙ্কটীকা নিজেরাই লিখে দিয়েছে।

তাই পৃথিবীর সর্বত্রই শোনা যায় তাদের গগনবিদারী আর্তচিৎকার, তাদের রাঙা খুনে রঞ্জিত হচ্ছে সবুজ-শ্যামল পৃথিবী। এর থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হলো আবার কলম হাতে নেয়া। হারানো গৌরবগুলো পুনরুদ্ধার করা। জাতির এ ক্রান্তিকালে জ্ঞানীর গবেষণা যেন থেমে না যায়, কলমের কালি যেন শুকিয়ে না যায়, জবান যেন স্তব্ধ হয়ে না যায়।

লেখক :

  • মাওলানা কাওসার আহমদ যাকারিয়া

ইসলামী কলামিস্ট, মজলিশপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

আজকের সূর্যোদয়

আজকের সূর্যোদয় প্রত্রিকায় আপনাদের স্বাগতম। ‍আমাদের নিউজ পড়ুন এবং বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদের পাশে থাকুন।

বরিশালে মুজিবিয়ানের ৮৭ নেতাকে খুঁজছে গোয়েন্দা সংস্থা

‘কলম’ শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার

আপডেট সময় ১২:০১:২৭ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩

মানব সৃষ্টির পর মানুষের শিক্ষার প্রসঙ্গটি উল্লিখিত হয়েছে। কারণ, শিক্ষাই মানুষকে অন্যান্য জীবজন্তু থেকে স্বতন্ত্র এবং সৃষ্টির সেরা রূপে চিহ্নিত করে। শিক্ষার পদ্ধতি সাধারণত দ্বিবিধ- ১. মৌখিক শিক্ষা এবং ২. কলম ও লেখার মাধ্যমে শিক্ষা। পবিত্র কুরআনুল কারিমের সূরা আলাকের শুরুতে ইকরা শব্দের মধ্যে মৌখিক শিক্ষা রয়েছে। কিন্তু ওই সূরার চতুর্থ আয়াতে শিক্ষাদান সম্পর্কিত বর্ণনায় কলমের সাহায্যে শিক্ষাকেই অগ্রে বর্ণনা করা হয়েছে।

কলম হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত একটি বড় নিয়ামত। যারা কলমকে সত্য ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে তারা দুনিয়াতে হাজার বছর বেঁচে থাকেন। কলম না থাকলে পৃথিবীতে কোনো কিছুই প্রতিষ্ঠিত হতো না। দুনিয়ার কায়-কারবারও সঠিকভাবে পরিচালিত হতো না। দয়াময় প্রভু মানবজাতিকে অপরূপ সৌন্দর্য দিয়ে বৈচিত্র্যময় করে সৃষ্টি করে তাদের হাতে কলম উঠিয়ে দিয়েছেন। আর এ কলমের সাহায্যেই তারা শিক্ষা, সভ্যতা, সংস্কৃতি, প্রগতি, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, তথ্যপ্রযুক্তি লিখে দিন দিন আধুনিকতার চরম উন্নতির শিখরে আরোহণ করছে। কলমকে বলা হয় হৃদয়ের জিহ্বা, জড় জগতের সবচেয়ে সম্মানী বস্তু। মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠত্বের দিক দিয়ে এটি অদ্বিতীয় ও অতুলনীয়। এর শক্তি অপরিসীম। এটি এক প্রচণ্ড দ্রোহ, শাণিত কৃপাণ, অসত্যের বিরুদ্ধে এক বজ্রকঠিন হাতিয়ার। টেইলর বলেছেন, ‘কলম হলো যন্ত্রপাতির মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক। এটি তরবারির চেয়েও ধারালো, চাবুক বা লোহার ডাণ্ডার চেয়েও ভয়াবহ।’
রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা যখন আদিকালে সব কিছু সৃষ্টি করেন, তখন আরশে তাঁর কাছে রক্ষিত কিতাবে এ কথা লিপিবদ্ধ করেন, আমার রহমত আমার ক্রোধের উপর প্রবল থাকবে। হাদিসে আরো বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করেন এবং তাকে লেখার নির্দেশ দেন। সে মতে কলম কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু হবে, সব লিখে ফেলে। এ কিতাব আল্লাহর কাছে আরশে রক্ষিত আছে’ (কুরতুবি)।

সূরা আলাকের চতুর্থ আয়াতে আছে কলমের সাহায্যে শিক্ষাদানের বর্ণনা। আর পঞ্চম আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রকৃত শিক্ষাদাতা আল্লাহ তায়ালা। তাঁর শিক্ষার মাধ্যমে অসংখ্য, অগণিত শুধু কলমের মধ্যেই সীমিত নয়। তাই বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন, যা সে আগে জানত না। এতে কলম অথবা অন্য কোনো উপায় উল্লেখ না করার মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, আল্লাহ তায়ালার এ শিক্ষা মানুষের জন্মলগ্ন থেকে অব্যাহত রয়েছে।

আল্লাহ বান্দাদেরকে অজ্ঞাত বিষয়সমূহের জ্ঞানদান করে ধন্য করেছেন এবং তাদেরকে মূর্খতার অন্ধকার থেকে জ্ঞানের আলোর দিকে টেনে নিয়ে এসেছেন। তিনি মানুষকে লিখন বিদ্যার প্রতি উৎসাহিত করেছেন। কেননা, যাবতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান, পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের ইতিহাস, জীবনালেখ্য ও উক্তি, আল্লাহ তায়ালার অবতীর্ণ কিতাবসমূহ যাবতীয় বিষয়াদিই কলমের সাহায্যে লিখিত হয়েছে এবং পৃথিবীর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অক্ষয় হয়ে থাকবে। কলম সৃজিত না হলে ইহকাল ও পরকালের সব কাজ কর্মেই বিঘিœত হতো।

কলমের একটি মাত্রই কাজ; আর তা হলো লেখা। চার্লস গ্রভিল বলেছেন, ‘একটি কলমের সাহায্যে যেভাবে হৃদয়ের কথা উৎসারিত হয়, তেমনি আর কিছুতেই হয় না।’ যিনি কলমের সাহায্যে সমাজের যাবতীয় অন্যায়, অত্যাচার-অবিচার, জুলুম-অনাচার ও নির্যাতন-নিপীড়ন দূর করতে চান তাকে হতে হয় সত্যের পক্ষে অকুতোভয় সৈনিক। তাকে মোকাবেলা করতে হয় নিদারুণ দুঃখ-মুসিবত, চলতে হয় নিঃসীম অন্ধকার পথে-ঢাকনাবিহীন ম্যানহোলের ওপর দিয়ে, পার হতে হয় কাঁটাবনের ঠিক মাঝখান দিয়ে, বন্ধু করে নিতে হয় ক্ষুধা-দারিদ্র্য আর অভাব-অনটনকে। পৃথিবীর বড় কলম সৈনিকদের জীবনেতিহাস পাঠ করলে আমাদের সামনে উপরিউক্ত চিত্রগুলোই ফুটে উঠে। আল্লামা ইকবাল, জর্জ বার্নাড শ, কাজী নজরুল ইসলাম, ইমাম গাজ্জালি, ইবনে তাইমিয়া, আল ফারাবি, শেখ সাদী প্রমুখের সংগ্রামী জীবন এবং তাদের ক্ষুরধার লেখনীই বিশ্ব সভ্যতাকে অজ্ঞতার তিমির থেকে টেনে তুলে আলোর সোনালি দিগন্তে নিয়ে আসে। যে কলম দেশাত্মবোধ, মানবতা, উদারতা, মহানুভবতা প্রতিভার বিকাশ সাধন করে মানুষের সঠিক পরিচয় তুলে ধরে প্রভুর সাথে যথাযথ সম্পর্ক তৈরি করে দিতে পারে না, সে কলম ধারালো কলম নয়; সে কলম ভোঁতা কলম, অকেজো কলম।

যে কলম বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা করে তামাম দুনিয়ার মানুষকে শান্তির সামিয়ানায় এনে দাঁড় করায়। যে কলম নির্যাতিত, নিপীড়িত, অবহেলিত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত, ক্ষুধার্ত, সর্বহারা, দিশেহারা ও হতাশাগ্রস্তদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে; সে কলমই নৈতিক কলম, কল্যাণকামী কলম, সংগ্রামী কলম। আর এ কলমই সমাজের বিনির্মাণের শাণিত হাতিয়ার, এমন এক সম্মোহনী শক্তি যার শক্তি হাজারো তরবারি থেকেও ধারালো। কলমকে যদি প্রকৃতির ভাষা হিসেবে নিরূপণ করা যায় তাহলে এর সাহায্যে প্রকৃত শৈল্পিক সৌন্দর্য ফুটে উঠবে।

জ্ঞানী সম্প্রদায় বলেন, ‘জগতে তিনটি কলম আছে- ১. আল্লাহ তায়ালার কুদরতি হস্তে সৃজিত কলম : একে তিনি তাকদির লেখার কাজে আদেশ করেছিলেন; ২. ফেরেশতাদের কলম : যা দ্বারা তারা ভবিতব্য ঘটনা, তার পরিণাম ও মানুষের আমলনামা লিপিবদ্ধ করেন; ৩. সাধারণ মানুষের কলম : যা দিয়ে তারা নিজেদের কথাবার্তা, অর্জিত জ্ঞান, ভাবাবেগ, চিত্ত চেতনার কথা লিখে এবং নিজেদের অভীষ্ট কাজে ব্যবহার করে।’ লিখন প্রকৃতপক্ষে এক প্রকার বর্ণনা এবং বর্ণনা মানুষের এক বিশেষ গুণ যা আল্লাহপাক প্রদত্ত। প্রখ্যাত তাফসিরবিদ মোজাহিদ আবু আমের বলেন, ‘মহান আল্লাহপাক চারটি বস্তু স্বীয় কুদরতি হস্তে সৃষ্টি করেছেন। এ চার বস্তু ব্যতীত সমগ্র সৃষ্টিজগৎ ও বস্তুসমূহ ‘কুন’- তথা হয়ে যাও আদেশের দ্বারা সৃষ্টি করেছেন।

আল্লাহর স্বহস্তে সৃজিত চারটি বস্তু হলো- কলম, আরশ, জান্নাতুল আদন ও হজরত আদম আ:।

মনীষীরা বলেছেন, ‘বিদ্বানের কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও পবিত্র’। তাই কলমকে বানাতে হবে সত্যের প্রতিষ্ঠা আর মিথ্যা বিতাড়নের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার হিসেবে। ন্যায়ের পক্ষে আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে এটি হবে ধারালো অস্ত্র। নীতির প্রতিষ্ঠা আর দুর্নীতি নির্মূলকরণের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। এ কলমই পারে মননশীল সাহিত্য রচনার মাধ্যমে জাতিকে অনেক বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখাতে, দেশাত্মবোধ জাগ্রত করে দেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে।

আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন, শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না’ (সূরা আলাক : ৪-৫)। রাসূল সা: বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা যখন আদিকালে সব কিছু সৃষ্টি করেন, তখন আরশে তার কাছে রক্ষিত কিতাবে এ কথা লিপিবদ্ধ করেন যে, আমার রহমত আমার ক্রোধের উপর প্রবল থাকবে।’ ইবনে মুবারক রহ: বলেন, ‘সত্যিকার জ্ঞানী হতে হলে সর্বদা নিজকে জ্ঞান অন্বেষণে মগ্ন রাখতে হবে। আর যে নিজকে জ্ঞানী ভেবে নেয় সে প্রকৃত জ্ঞানী নয়, সে মূর্খ।’ হজরত ঈসা আ: বলেন, ‘অসৎ জ্ঞানীর উপমা সেই পাথরের মতো যেটি ঝরনার মুখে পড়ে পানির প্রবাহ বন্ধ করে দেয়; সে নিজেও পানি পান করে না এবং শস্যক্ষেতেও পানি যেতে দেয় না।’ হজরত সুফিয়ান সওরি রহ: বলেন, ‘এলেম চিৎকার করে আমলের আহ্বান জানায়, তার দাবি এ আহ্বানে সাড়া দিলে এলেম থাকে, অন্যথায় বিদায় নিয়ে চলে যায়।’ আর কলমই হলো জ্ঞান লিখার একমাত্র মাধ্যম।

বর্তমান পৃথিবীতে যাদের কলমের জোর বেশি তারাই শক্তিশালী। বিশ্ব চলে তাদের দাপটে, পৃথিবীকে মেনে নিতে হয় তাদের কর্তৃত্ব। এক সময় মুসলমানদের কলমের শক্তি ছিল প্রবল। তারা তাদের কলমের আঁচড়ে সারা পৃথিবীকে আলোয় আলোকিত করে তুলেছিলেন। তাদের দোয়াতের কালিতে লেখা হয়েছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সবগুলো অধ্যায়। অধুনা পৃথিবী আজো শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে তাদের গৌরবগাথা, কৃতিত্বের কথা, তাদের ক্ষুরধার লেখনীর কথা। কেননা, তাদের কলমের ধারালো লেখনীই পৃথিবীকে করে তুলেছে উদ্ভাসিত ও দীপ্তিময়। এভাবে যতদিন মুসলমানদের হাতে কলম ছিল ততদিন পৃথিবীবাসী তাদের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিল। আর এখন তারা কলম ছুড়ে ফেলে দিয়ে ভোগ-বিলাস আর আরাম-আয়েশের জিন্দেগি শুরু করার মাধ্যমে নিজেদের ললাটে অপমান আর জিল্লতির কলঙ্কটীকা নিজেরাই লিখে দিয়েছে।

তাই পৃথিবীর সর্বত্রই শোনা যায় তাদের গগনবিদারী আর্তচিৎকার, তাদের রাঙা খুনে রঞ্জিত হচ্ছে সবুজ-শ্যামল পৃথিবী। এর থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায় হলো আবার কলম হাতে নেয়া। হারানো গৌরবগুলো পুনরুদ্ধার করা। জাতির এ ক্রান্তিকালে জ্ঞানীর গবেষণা যেন থেমে না যায়, কলমের কালি যেন শুকিয়ে না যায়, জবান যেন স্তব্ধ হয়ে না যায়।

লেখক :

  • মাওলানা কাওসার আহমদ যাকারিয়া

ইসলামী কলামিস্ট, মজলিশপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া