ঢাকা , সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ আর নয়, এবার কল্যাণমুখী বাজার অর্থনীতি চালু করুন

  • ড. আর এম দেবনাথ
  • আপডেট সময় ১১:৫৩:১৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২৪
  • ১১৩৩ বার পড়া হয়েছে

২০২৪ সালটি শুরু হলো নতুন সরকার দিয়ে। পরিচিত-অপরিচিত মুখ দিয়ে তা গঠিত। তাদের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। প্রথম প্রত্যাশাটাই হচ্ছে মূল্যস্ফীতি রোধ। আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারেও দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনার বিষয়টিকে বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, সরকার তার কাজ শুরু করবে একে প্রাধান্য দিয়ে। যদিও বিশেষ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত কাজের মধ্যে রয়েছে আরও ১০টি কাজ। মোট ১১টি বিশেষ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত কাজের মধ্যে দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার অঙ্গীকার এক নম্বরে। যদি তাই হয়, তাহলে অবশ্যকরণীয়ের মধ্যে পড়ে বেশ কয়েকটি কাজ। মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি ও বাণিজ্যনীতির সমন্বয় ছাড়া দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানা সম্ভব নয়। এটাও আজ পরিষ্কার-এ তিন নীতির সমন্বয়েও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি, আসছে না। গেল নভেম্বরেও মূল্যস্ফীতির হার ছিল প্রায় ১০ শতাংশ। এর মধ্যে আবার খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বেশি। এবং তা কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কাঁচাবাজার, মাছ-মাংসের বাজার তা-ই বলে। কোনো জিনিসের দামই এই ভরা শীতকালেও কমেনি, বরং কোনো কোনোটির দাম বেড়েছে। যেমন অতিপ্রয়োজনীয় চালের দাম আমন মৌসুমেও একটুও কমেনি। বরং বৃহস্পতিবার পর্যন্ত খবর হচ্ছে, চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী। কারণ হিসাবে খবরের কাগজে চালের মিল মালিকদের দায়ী করা হচ্ছে, যা অতীতেও হয়েছে। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে চালকল মালিক এবং বড় বড় আড়তদার। দীর্ঘদিন ধরে বলা হচ্ছে, চালের বাজারে ‘সিন্ডিকেট’ কাজ করছে।

শুধু চালের বাজার নয়, সব ভোগ্যপণ্য এবং অতিপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে কিছুসংখ্যক ব্যবসায়ী। এটা আমার কথা নয়, পূর্বতন মন্ত্রিসভার বাণিজ্যমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী, শিল্পমন্ত্রীসহ সবাই একবাক্যে বলেছেন, ভোগ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে একটা সিন্ডিকেট। চাল, গম, সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, আটা-ময়দা, ডিম, দুধ, গোল আলু থেকে শুরু করে সব পণ্যের বাজারে কাজ করছে সিন্ডিকেট। খবরের কাগজের রিপোর্ট, অর্থনীতিবিদদের মন্তব্য ইত্যাদিও প্রমাণ করে-সিন্ডিকেট আমাদের জ্বালিয়ে মারছে। একজন সাবেক মন্ত্রী তো বলেইছিলেন যে, সিন্ডিকেট দমন করা সম্ভব নয়। এরা খুবই শক্তিশালী। এদের গায়ে হাত দিলে বাজার তছনছ করে দেবে তারা। দৃশ্যত বোঝাও যাচ্ছে তা। সিন্ডিকেটের সদস্যরা নিজেদের অর্থ লগ্নি করেছে ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়। রয়েছে ব্যাংকের উদার ফিন্যান্স। তারা এত বড় যে নিজেদের জাহাজেই তারা পণ্য আমদানি করে। অথচ স্বাধীনতার পর ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা ‘গ্রুপ এলসি’ করে আমদানি করত। টাকা ছিল না। আজ আর এ অবস্থা নেই। বড় বড় ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ী আমদানি করে। পণ্য প্রসেস করে, স্টোর করে, পাইকারি বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। এ অবস্থায় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, সিন্ডিকেটের কাছে বিগত সরকার ছিল অসহায়। তাহলে নতুন সরকার কী করবে?

নতুন সরকারের প্রথম ও প্রধান কাজ হচ্ছে ‘সিন্ডিকেট’ ভেঙে চুরমার করে দেওয়া। যেহেতু এ সরকার চায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে, দ্রব্যমূল্যকে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনতে। অথচ সিন্ডিকেট যতদিন সক্রিয় থাকবে, তাদের দাপট যতদিন অব্যাহত থাকবে, তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি যতদিন নিয়ন্ত্রণহীন থাকবে-ততদিন জিনিসপত্রের দাম কমানো সম্ভব নয়। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে চাল, ডাল, তেলের দাম কমতির দিকে। সিন্ডিকেটের কারণে আমরা এর সুবিধা পাচ্ছি না। উলটো এখন আবার নতুন আশঙ্কায় আছি আমরা। সামনে পবিত্র রমজান মাস। রমজান উপলক্ষ্যে সিন্ডিকেট, আড়তদার, এমনকি ছোট-মাঝারি ব্যবসায়ীরাও বছরের ব্যবসা করে এক মাসের মধ্যে। তেমনি বাজেটের সময়, ঝড়-বৃষ্টি-তুফান-খরা ইত্যাদির সময়েও তারা তা করে। তারা এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে। আবার সুবিধা হয়েছে-তারা এখন নির্বাচনি রাজনীতিতেও ঢুকছেন। রাজনীতি, দল, প্রশাসন, ব্যবসা, ব্যাংক-বিমা সব এখন তারা নিয়ন্ত্রণে নিতে চাইছেন। এক্ষেত্রে তারা যথেষ্ট এগিয়ে গেছেন।

এ অবস্থায় নতুন সরকার চাইলে এবার সম্পূর্ণ নতুনভাবে শুরু করতে পারে। তারা বলতে পারে, যা হয়েছে, তা হয়েছে। আমাদের পুঁজি ছিল না, ৫০ বছরে যথেষ্ট পুঁজি গঠন হয়েছে। আর নয়। এখন আর ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ চলবে না। এখন আর অদক্ষতার স্থান হবে না। পুরোপুরি চালু হবে বাজার অর্থনীতি (মার্কেট ইকোনমি), কল্যাণমুখী বাজার অর্থনীতি, যেখানে মানুষের স্বার্থ, ভোক্তার স্বার্থই পাবে প্রাধান্য। এ উদ্দেশ্যে ‘সিন্ডিকেট’ ভাঙা শুরু করতে হবে। সুশাসনের খাতিরে সরকারি জমি, পরিত্যক্ত সম্পত্তি, শত্রু (অর্পিত) সম্পত্তি, নদী-নালা, পাহাড়, বিল, হাওড় দখল করা আর চলবে না। ব্যাংক চলবে ব্যাংকের নিয়মে। কম সুদে ঋণপ্রাপ্তি, ঋণ মওকুফ, সুদ মওকুফ, ঘন ঘন ঋণ পুনঃতফশিল, ঋণ পুনর্গঠন, কম হারে ট্যাক্স প্রদান, কর অব্যাহতি, কর অবকাশ আর ঢালাওভাবে দেওয়া হবে না। এসব কথা পরিষ্কার করে দেওয়ার সময় এখনই। আইন-কানুন, নিয়মনীতি মেনে পয়সা বানাতে হবে। দেশের প্রচলিত যত আইন আছে, তার প্রতি সম্মান দেখিয়ে ব্যবসা করতে হবে। ব্যবসার মূলনীতি হতে হবে প্রতিযোগিতা, দক্ষতা, মেধা ও শ্রম। এই চার নীতির ভিত্তিতে ব্যবসা-বাণিজ্য-শিল্প চলবে।

সিন্ডিকেট ভাঙলে, বড় বড় ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করলে ব্যবসা জগতে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, তা সামাল দেওয়া হবে। এর মোক্ষম ওষুধ হচ্ছে ছোট ছোট উদ্যোগ, মাঝারি ব্যবসা, দেশীয় ছোট-মাঝারি শিল্প। এরা এখন পর্যন্ত অবহেলিত। এরা ব্যাংকের ঋণ পায় না। সরকারি সুবিধা থেকে এরা বঞ্চিত। যা কিছু সরকারি সুবিধা আছে তা ভেঙে খায় বড় বড় ব্যবসায়ী ও গ্রুপ ব্যবসায়ীরা। বড় বড় গ্রুপ ব্যবসায়ীর ব্যাংক ঋণ হাজার হাজার কোটি টাকা। সব ঋণ কুক্ষিগত হচ্ছে তাদের হাতে, তাও সারা দেশে নয়, দেশের কিছু অঞ্চল এবং অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যাচ্ছে ব্যাংকের ফিন্যান্স। এর জন্য সরকারি নীতি যেমন দায়ী, তেমনি দায়ী ব্যাংকাররাও। তারা বড় বড় ব্যবসায়ীকে ঋণ দিতে পছন্দ করেন। এক্ষেত্রে তারা কোনো বাছবিচার করেন না। বড় ব্যবসায়ীর কথা শুনলেই বিনা বিচারে তারা ঋণ দিয়ে দেন। ফলে ঋণখেলাপি সমস্যা বাড়ছে। মন্দ ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। ব্যাংকের বকেয়া ঋণ আদায় হচ্ছে না। কর সুবিধা, কর অবকাশ সুবিধা, বিদেশি ঋণ ইত্যাদিতেও বড় বড় ব্যবসায়ীর আধিপত্য। এ দুষ্টচক্র ভাঙতে হলে ছোটদের প্রতি নজর দিতে হবে এবং তা সরকারের এ মেয়াদেই, এখনই শুরু করতে হবে। প্রথমেই এই ‘মেসেজ’ গেলে সবাই সাবধান হবে। বলা দরকার সিন্ডিকেট, বিগ বিজনেসের যন্ত্রণায় ছোট ছোট উৎপাদক মার খাচ্ছে। ছোট ছোট উদ্যোক্তা শ্রমজীবী হচ্ছেন। করপোরেটের দাপট এখন মাত্রার বাইরে। এদের দমন করতে না পারলে দেশে যে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে, তা রোধ করা যাবে না। বিগত ১০-১৫-২০ বছরে আমাদের বৈষম্য মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এখনই তা সহ্যসীমার বাইরে। এটি শুধরানোর জন্যও আমাদের উচিত হবে সিন্ডিকেট দমন করা। সিন্ডিকেট শক্তিশালী সন্দেহ নেই। কিন্তু সিন্ডিকেট সরকারের চেয়ে শক্তিশালী, এটা মেনে নেওয়া যায় না।

সিন্ডিকেট আমাদের ব্যাংক ব্যবসাকে তছনছ করে দিচ্ছে। এ খাতে সংস্কার দরকার ছিল অনেক আগেই। যখনই সংস্কারের কথা ওঠে, তখনই কতগুলো অহেতুক পদক্ষেপ নেওয়া হয়। যেমন আজ থেকে ১৫-২০ বছর আগে সরকারি ব্যাংকগুলোকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি করা হলো। ব্যাস এ পর্যন্তই। এই ব্যাংকগুলোকে কোম্পানি আইনানুযায়ী চলতে দেওয়া হয়নি। আগে বাতিল করা অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগ আবার চালু করে ব্যাংকগুলোর স্বায়ত্তশাসন নষ্ট করে দেওয়া হয়। ব্যাংক খাতে তৈরি হয় দ্বৈত শাসন। বাংলাদেশ ব্যাংক অসহায়। বলা যায়, তারা হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের হাতের পুতুল। বিনা প্রতিবাদে তারা সবকিছু মেনে নেয়। এ দ্বৈত শাসনের কুফল এখনো আমরা ভোগ করছি। অথচ আমরা জানি, এই দ্বৈত শাসনের পরিসমাপ্তি দরকার। নতুন সরকার এটি করলে ব্যাংক খাতে সুশাসনের একটা ধারা ফিরে আসতে পারে। ইতঃপূর্বে দেখা গেছে, আরেকটা লোক দেখানো ‘সংস্কার’ করা হয়েছে। সব ব্যাংক হচ্ছে পাবলিক লায়াবিলিটি কোম্পানি (পিএলসি)। মানুষ মনে করে, না জানি কত বড় পরিবর্তন! ছিল লিমিটেড (লি.) কোম্পানি, হয়েছে ‘পিএলসি’।

হোক, কিন্তু যা ভীষণ দরকার তা তো হচ্ছে না। ব্যাংক খাতের, আর্থিক খাতের আমূল সংস্কার দরকার। দরকার একটা ‘কমিশনের’। কিন্তু এ ব্যাপারে বিদায়ি সরকার নীরব ছিল। নতুন সরকার কি এদিকে নজর দেবে? বিষয়টি ভীষণ জরুরি। ব্যাংক খাতকে সুশাসনের পথে আনতে না পারলে আর্থিক শৃঙ্খলা ফিরে আসবে না। এমনিতেই ‘নয়-ছয়’ সুদনীতি করে ব্যাংক খাতকে অহেতুক বাজার অর্থনীতির বাইরে নেওয়া আছে। নুতন সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা-কল্যাণমুখী বাজার অর্থনীতি ফিরিয়ে আনুন। ‘সিন্ডিকেট’ ভাঙুন, কঠোর হোন। ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের’ পথ রুদ্ধ করুন। এটা সাধারণ মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে। এতে উন্নয়ন হয়, কিন্তু সুষম বণ্টন হয় না উন্নয়নের ফসলের। এ যাত্রায় সুষমও বণ্টন নিশ্চিত করা দরকার।

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

আজকের সূর্যোদয়

আজকের সূর্যোদয় প্রত্রিকায় আপনাদের স্বাগতম। ‍আমাদের নিউজ পড়ুন এবং বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদের পাশে থাকুন।

বরিশালে মুজিবিয়ানের ৮৭ নেতাকে খুঁজছে গোয়েন্দা সংস্থা

‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ আর নয়, এবার কল্যাণমুখী বাজার অর্থনীতি চালু করুন

আপডেট সময় ১১:৫৩:১৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৩ জানুয়ারী ২০২৪

২০২৪ সালটি শুরু হলো নতুন সরকার দিয়ে। পরিচিত-অপরিচিত মুখ দিয়ে তা গঠিত। তাদের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। প্রথম প্রত্যাশাটাই হচ্ছে মূল্যস্ফীতি রোধ। আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারেও দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনার বিষয়টিকে বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, সরকার তার কাজ শুরু করবে একে প্রাধান্য দিয়ে। যদিও বিশেষ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত কাজের মধ্যে রয়েছে আরও ১০টি কাজ। মোট ১১টি বিশেষ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত কাজের মধ্যে দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার অঙ্গীকার এক নম্বরে। যদি তাই হয়, তাহলে অবশ্যকরণীয়ের মধ্যে পড়ে বেশ কয়েকটি কাজ। মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি ও বাণিজ্যনীতির সমন্বয় ছাড়া দ্রব্যমূল্যের লাগাম টানা সম্ভব নয়। এটাও আজ পরিষ্কার-এ তিন নীতির সমন্বয়েও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি, আসছে না। গেল নভেম্বরেও মূল্যস্ফীতির হার ছিল প্রায় ১০ শতাংশ। এর মধ্যে আবার খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বেশি। এবং তা কমার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কাঁচাবাজার, মাছ-মাংসের বাজার তা-ই বলে। কোনো জিনিসের দামই এই ভরা শীতকালেও কমেনি, বরং কোনো কোনোটির দাম বেড়েছে। যেমন অতিপ্রয়োজনীয় চালের দাম আমন মৌসুমেও একটুও কমেনি। বরং বৃহস্পতিবার পর্যন্ত খবর হচ্ছে, চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী। কারণ হিসাবে খবরের কাগজে চালের মিল মালিকদের দায়ী করা হচ্ছে, যা অতীতেও হয়েছে। চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে চালকল মালিক এবং বড় বড় আড়তদার। দীর্ঘদিন ধরে বলা হচ্ছে, চালের বাজারে ‘সিন্ডিকেট’ কাজ করছে।

শুধু চালের বাজার নয়, সব ভোগ্যপণ্য এবং অতিপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে কিছুসংখ্যক ব্যবসায়ী। এটা আমার কথা নয়, পূর্বতন মন্ত্রিসভার বাণিজ্যমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী, শিল্পমন্ত্রীসহ সবাই একবাক্যে বলেছেন, ভোগ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে একটা সিন্ডিকেট। চাল, গম, সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, আটা-ময়দা, ডিম, দুধ, গোল আলু থেকে শুরু করে সব পণ্যের বাজারে কাজ করছে সিন্ডিকেট। খবরের কাগজের রিপোর্ট, অর্থনীতিবিদদের মন্তব্য ইত্যাদিও প্রমাণ করে-সিন্ডিকেট আমাদের জ্বালিয়ে মারছে। একজন সাবেক মন্ত্রী তো বলেইছিলেন যে, সিন্ডিকেট দমন করা সম্ভব নয়। এরা খুবই শক্তিশালী। এদের গায়ে হাত দিলে বাজার তছনছ করে দেবে তারা। দৃশ্যত বোঝাও যাচ্ছে তা। সিন্ডিকেটের সদস্যরা নিজেদের অর্থ লগ্নি করেছে ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়। রয়েছে ব্যাংকের উদার ফিন্যান্স। তারা এত বড় যে নিজেদের জাহাজেই তারা পণ্য আমদানি করে। অথচ স্বাধীনতার পর ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা ‘গ্রুপ এলসি’ করে আমদানি করত। টাকা ছিল না। আজ আর এ অবস্থা নেই। বড় বড় ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ী আমদানি করে। পণ্য প্রসেস করে, স্টোর করে, পাইকারি বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। এ অবস্থায় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, সিন্ডিকেটের কাছে বিগত সরকার ছিল অসহায়। তাহলে নতুন সরকার কী করবে?

নতুন সরকারের প্রথম ও প্রধান কাজ হচ্ছে ‘সিন্ডিকেট’ ভেঙে চুরমার করে দেওয়া। যেহেতু এ সরকার চায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে, দ্রব্যমূল্যকে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনতে। অথচ সিন্ডিকেট যতদিন সক্রিয় থাকবে, তাদের দাপট যতদিন অব্যাহত থাকবে, তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি যতদিন নিয়ন্ত্রণহীন থাকবে-ততদিন জিনিসপত্রের দাম কমানো সম্ভব নয়। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে চাল, ডাল, তেলের দাম কমতির দিকে। সিন্ডিকেটের কারণে আমরা এর সুবিধা পাচ্ছি না। উলটো এখন আবার নতুন আশঙ্কায় আছি আমরা। সামনে পবিত্র রমজান মাস। রমজান উপলক্ষ্যে সিন্ডিকেট, আড়তদার, এমনকি ছোট-মাঝারি ব্যবসায়ীরাও বছরের ব্যবসা করে এক মাসের মধ্যে। তেমনি বাজেটের সময়, ঝড়-বৃষ্টি-তুফান-খরা ইত্যাদির সময়েও তারা তা করে। তারা এখন ধরাছোঁয়ার বাইরে। আবার সুবিধা হয়েছে-তারা এখন নির্বাচনি রাজনীতিতেও ঢুকছেন। রাজনীতি, দল, প্রশাসন, ব্যবসা, ব্যাংক-বিমা সব এখন তারা নিয়ন্ত্রণে নিতে চাইছেন। এক্ষেত্রে তারা যথেষ্ট এগিয়ে গেছেন।

এ অবস্থায় নতুন সরকার চাইলে এবার সম্পূর্ণ নতুনভাবে শুরু করতে পারে। তারা বলতে পারে, যা হয়েছে, তা হয়েছে। আমাদের পুঁজি ছিল না, ৫০ বছরে যথেষ্ট পুঁজি গঠন হয়েছে। আর নয়। এখন আর ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ চলবে না। এখন আর অদক্ষতার স্থান হবে না। পুরোপুরি চালু হবে বাজার অর্থনীতি (মার্কেট ইকোনমি), কল্যাণমুখী বাজার অর্থনীতি, যেখানে মানুষের স্বার্থ, ভোক্তার স্বার্থই পাবে প্রাধান্য। এ উদ্দেশ্যে ‘সিন্ডিকেট’ ভাঙা শুরু করতে হবে। সুশাসনের খাতিরে সরকারি জমি, পরিত্যক্ত সম্পত্তি, শত্রু (অর্পিত) সম্পত্তি, নদী-নালা, পাহাড়, বিল, হাওড় দখল করা আর চলবে না। ব্যাংক চলবে ব্যাংকের নিয়মে। কম সুদে ঋণপ্রাপ্তি, ঋণ মওকুফ, সুদ মওকুফ, ঘন ঘন ঋণ পুনঃতফশিল, ঋণ পুনর্গঠন, কম হারে ট্যাক্স প্রদান, কর অব্যাহতি, কর অবকাশ আর ঢালাওভাবে দেওয়া হবে না। এসব কথা পরিষ্কার করে দেওয়ার সময় এখনই। আইন-কানুন, নিয়মনীতি মেনে পয়সা বানাতে হবে। দেশের প্রচলিত যত আইন আছে, তার প্রতি সম্মান দেখিয়ে ব্যবসা করতে হবে। ব্যবসার মূলনীতি হতে হবে প্রতিযোগিতা, দক্ষতা, মেধা ও শ্রম। এই চার নীতির ভিত্তিতে ব্যবসা-বাণিজ্য-শিল্প চলবে।

সিন্ডিকেট ভাঙলে, বড় বড় ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করলে ব্যবসা জগতে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, তা সামাল দেওয়া হবে। এর মোক্ষম ওষুধ হচ্ছে ছোট ছোট উদ্যোগ, মাঝারি ব্যবসা, দেশীয় ছোট-মাঝারি শিল্প। এরা এখন পর্যন্ত অবহেলিত। এরা ব্যাংকের ঋণ পায় না। সরকারি সুবিধা থেকে এরা বঞ্চিত। যা কিছু সরকারি সুবিধা আছে তা ভেঙে খায় বড় বড় ব্যবসায়ী ও গ্রুপ ব্যবসায়ীরা। বড় বড় গ্রুপ ব্যবসায়ীর ব্যাংক ঋণ হাজার হাজার কোটি টাকা। সব ঋণ কুক্ষিগত হচ্ছে তাদের হাতে, তাও সারা দেশে নয়, দেশের কিছু অঞ্চল এবং অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যাচ্ছে ব্যাংকের ফিন্যান্স। এর জন্য সরকারি নীতি যেমন দায়ী, তেমনি দায়ী ব্যাংকাররাও। তারা বড় বড় ব্যবসায়ীকে ঋণ দিতে পছন্দ করেন। এক্ষেত্রে তারা কোনো বাছবিচার করেন না। বড় ব্যবসায়ীর কথা শুনলেই বিনা বিচারে তারা ঋণ দিয়ে দেন। ফলে ঋণখেলাপি সমস্যা বাড়ছে। মন্দ ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। ব্যাংকের বকেয়া ঋণ আদায় হচ্ছে না। কর সুবিধা, কর অবকাশ সুবিধা, বিদেশি ঋণ ইত্যাদিতেও বড় বড় ব্যবসায়ীর আধিপত্য। এ দুষ্টচক্র ভাঙতে হলে ছোটদের প্রতি নজর দিতে হবে এবং তা সরকারের এ মেয়াদেই, এখনই শুরু করতে হবে। প্রথমেই এই ‘মেসেজ’ গেলে সবাই সাবধান হবে। বলা দরকার সিন্ডিকেট, বিগ বিজনেসের যন্ত্রণায় ছোট ছোট উৎপাদক মার খাচ্ছে। ছোট ছোট উদ্যোক্তা শ্রমজীবী হচ্ছেন। করপোরেটের দাপট এখন মাত্রার বাইরে। এদের দমন করতে না পারলে দেশে যে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে, তা রোধ করা যাবে না। বিগত ১০-১৫-২০ বছরে আমাদের বৈষম্য মারাত্মকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এখনই তা সহ্যসীমার বাইরে। এটি শুধরানোর জন্যও আমাদের উচিত হবে সিন্ডিকেট দমন করা। সিন্ডিকেট শক্তিশালী সন্দেহ নেই। কিন্তু সিন্ডিকেট সরকারের চেয়ে শক্তিশালী, এটা মেনে নেওয়া যায় না।

সিন্ডিকেট আমাদের ব্যাংক ব্যবসাকে তছনছ করে দিচ্ছে। এ খাতে সংস্কার দরকার ছিল অনেক আগেই। যখনই সংস্কারের কথা ওঠে, তখনই কতগুলো অহেতুক পদক্ষেপ নেওয়া হয়। যেমন আজ থেকে ১৫-২০ বছর আগে সরকারি ব্যাংকগুলোকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি করা হলো। ব্যাস এ পর্যন্তই। এই ব্যাংকগুলোকে কোম্পানি আইনানুযায়ী চলতে দেওয়া হয়নি। আগে বাতিল করা অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগ আবার চালু করে ব্যাংকগুলোর স্বায়ত্তশাসন নষ্ট করে দেওয়া হয়। ব্যাংক খাতে তৈরি হয় দ্বৈত শাসন। বাংলাদেশ ব্যাংক অসহায়। বলা যায়, তারা হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের হাতের পুতুল। বিনা প্রতিবাদে তারা সবকিছু মেনে নেয়। এ দ্বৈত শাসনের কুফল এখনো আমরা ভোগ করছি। অথচ আমরা জানি, এই দ্বৈত শাসনের পরিসমাপ্তি দরকার। নতুন সরকার এটি করলে ব্যাংক খাতে সুশাসনের একটা ধারা ফিরে আসতে পারে। ইতঃপূর্বে দেখা গেছে, আরেকটা লোক দেখানো ‘সংস্কার’ করা হয়েছে। সব ব্যাংক হচ্ছে পাবলিক লায়াবিলিটি কোম্পানি (পিএলসি)। মানুষ মনে করে, না জানি কত বড় পরিবর্তন! ছিল লিমিটেড (লি.) কোম্পানি, হয়েছে ‘পিএলসি’।

হোক, কিন্তু যা ভীষণ দরকার তা তো হচ্ছে না। ব্যাংক খাতের, আর্থিক খাতের আমূল সংস্কার দরকার। দরকার একটা ‘কমিশনের’। কিন্তু এ ব্যাপারে বিদায়ি সরকার নীরব ছিল। নতুন সরকার কি এদিকে নজর দেবে? বিষয়টি ভীষণ জরুরি। ব্যাংক খাতকে সুশাসনের পথে আনতে না পারলে আর্থিক শৃঙ্খলা ফিরে আসবে না। এমনিতেই ‘নয়-ছয়’ সুদনীতি করে ব্যাংক খাতকে অহেতুক বাজার অর্থনীতির বাইরে নেওয়া আছে। নুতন সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা-কল্যাণমুখী বাজার অর্থনীতি ফিরিয়ে আনুন। ‘সিন্ডিকেট’ ভাঙুন, কঠোর হোন। ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের’ পথ রুদ্ধ করুন। এটা সাধারণ মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে। এতে উন্নয়ন হয়, কিন্তু সুষম বণ্টন হয় না উন্নয়নের ফসলের। এ যাত্রায় সুষমও বণ্টন নিশ্চিত করা দরকার।

ড. আর এম দেবনাথ : অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়