অনেকেই মনে করে, রজব মাসেই মহানবী সা:-এর পবিত্র মিরাজ হয়েছে। তাই এ মাসের রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব ও ফজিলত। অনেকে আবার একটু বাড়িয়ে বলেন যে, রজবের ২৭ তারিখেই মহানবী সা:-এর পবিত্র মিরাজ হয়েছে। তাই এ রাত অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। কোনো কোনো কিতাবে লিখেছে যে, শবেমিরাজের ফজিলত শবেকদরের চেয়েও বেশি। তাই এ রাতের জন্য অনেকেই আবিষ্কার করেছে বিশেষ বিশেষ পদ্ধতির সালাত ও ইবাদত। এ রাতে এত রাকাত সালাত পড়তে হবে অমুক অমুক সূরা দিয়ে। মূলত পুরো মাসটির ব্যাপারে মহানবী সা: থেকে বিশুদ্ধ সনদ দ্বারা যে আমলের কথা জানা যায়, তা হলো- যখন রাসূলুল্লাহ সা: রজবের চাঁদ দেখতেন, তখন নিম্নের দোয়াটি পড়তেন- ‘আল্লøাহুম্মা বারিক লানা ফি রজবা ওয়া শাবান ওয়া বাল্লিগনা রামাজান।’ (হে সালাত! আপনি আমাদেরকে রজব ও শাবান মাসে বরকত দান করুন আর আমাদের হায়াত বৃদ্ধি করে রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন) কেবল এই দোয়াটিই রাসূলুল্লাহ সা: থেকে বিশুদ্ধ সনদের মাধ্যমে প্রমাণিত। তাই রজবের চাঁদ দেখে এ দোয়াটি পাঠ করা সুন্নত। এ দোয়া ব্যতীত অন্য যেসব রুসুম-রেওয়াজ মানুষের মধ্যে প্রচলিত, সেগুলোর কোনো ভিত্তি শরিয়তে নেই। (মুসনাদে আহমাদ-২৩৪৭, শুআবুল ঈমান, বায়হাকি-৩৫৩৪; আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া-২/৪১৭, লাইলাতুল মাআরিফ, ইমাম ইবনে রজব-১৩৪; ইসলাহি খুতুবাত-১/৪৭-৪৮)
মিরাজের তারিখ বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত নয়
মিরাজের তারিখ কোনো বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত নয়। ২৭ রজবের তারিখটি মূলত প্রসিদ্ধি লাভ করেছে শুধু একটি ঐতিহাসিক বর্ণনার ভিত্তিতে, যার সনদ সহিহ নয়। এই তারিখটি কোনো নির্ভরযোগ্য ইতিহাস দ্বারাও প্রমাণিত নয়। কোনো হাদিস কিংবা সাহাবির উক্তি দ্বারা তো নয়ই। নির্ভরযোগ্য সূত্রে শুধু এতটুকুই পাওয়া যায় যে, মিরাজের ঘটনা হিজরতের এক বা দেড় বছর আগে সংঘটিত হয়েছিল। মাস, দিন ও তারিখের ব্যাপারে বিশুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য কোনো দলিল নেই। বাস্তবেই যদি শবেমিরাজ শবেকদরের মতো মর্যাদাবান বিশেষ কোনো রাত হতো কিংবা এ রাতের জন্য বিশেষ কোনো ইবাদত-বন্দেগি থাকত, তাহলে নিশ্চয় এর দিন, তারিখ, মাস ইত্যাদি গুরুত্বের সাথে সংরক্ষণ করা হতো। এখান থেকেই আন্দাজ করা যায়, ২৭ রজব উপলক্ষে আমরা যা কিছু করছি, এর সবই ভিত্তিহীন ও নিজেদের মনগড়া আবিষ্কৃত। সত্য ও বাস্তবতার সাথে এর কোনো সম্পর্কই নেই। (আল মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া ও শরহে মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া : ৮/১৮-১৯, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া-২/৪১৭, লাইলাতুল মাআরিফ, ইমাম ইবনে রজব-১৩৪; ইসলাহি খুতুবাত-১/৪৭-৪৮)
রাসূলুল্লাহ সা: ও সাহাবিরা কখনো শবেমিরাজ পালন করেননি
যদি এ কথা মেনেও নেয়া হয় যে, ২৭ রজবই নবীজী সা: মিরাজে তাশরিফ নিয়েছিলেন, তাহলে প্রশ্ন জাগে, এরপরও মহানবী সা: কমপক্ষে ১১-১২ বছর জীবিত ছিলেন। সে হিসাবে রাসূলুল্লাহ সা:-এর জীবনেও ১১-১২ বার শবেমিরাজ এসেছিল। কিন্তু তার জীবদ্দশায় তিনি নিজে কোনো সময় শবেমিরাজ উদযাপন করনেনি এবং কোনো সাহাবিকেও তা উদযাপনের বিশেষ কোনো নির্দেশ দেননি। আরো ব্যাপার হলো, রাসূলুল্লাহ সা:-এর ইন্তেকালের পর তাঁর আদর্শে প্রাণ উৎসর্গকারী সাহাবি রা:-এর সুমহান জামাত এই পৃথিবীতে আরো ১০০ বছর পর্যন্ত জীবিত ছিলেন। এই ১০০ বছরে কোনো একজন সাহাবিও ২৭ রজবকে বিশেষ কোনো মর্যাদা দিয়েছেন বা এ রাতে বিশেষ কোনো আমল করেছেন এমন কোনো প্রমাণ নেই। (ইসলাহি খুতুবাত-১/৪৮-৪৯)
২৭ রজবের রোজা প্রমাণিত নয়
এভাবে কেউ কেউ ২৭ রজবে রোজা রাখাকেও ফজিলতপূর্ণ বলে মনে করেন। তাদের ধারণা আশুরা, শবেবরাত ও আরাফার রোজার মতো ২৭ রজবের রোজাও ফজিলতময়। এ ব্যাপারে সঠিক কথা হলো- ২৭ রজবের রোজা বিশুদ্ধ কোনো সনদের মাধ্যমে প্রমাণিত নয়। তাই তো উমর রা:-এর শাসনামলে একবার কিছু লোক ২৭ রজবে রোজা রাখতে শুরু করলে তিনি নিজে একেকজনের কাছে গিয়ে জোরপূর্বক তাদেরকে খাবার খাইয়ে তাদের রোজা ভাঙালেন এবং ‘রোজা রাখেনি’ এ কথার স্বীকারোক্তি সবার কাছ থেকে নিয়ে ছাড়লেন। তবে হ্যাঁ, মিরাজের উপলক্ষ ছাড়া অন্যান্য দিনের মতো এ দিনেও সাধারণ নফল রোজা রাখা যাবে। (ইসলাহি খুতুবাত-১/৫০-৫১)
মিরাজে কত বছর অতিবাহিত হয়েছিল
কিছু কিছু মানুষকে বলতে শোনা যায়, মিরাজের সফরে রাসূলুল্লাহ সা:-এর ২৭ বছর অতিবাহিত হয়েছিল। সে সময় সূর্য ও সময়ের গতি থেমে গিয়েছিল। এ অবস্থায় ২৭টি বছর কেটে গিয়েছিল। মূলত এ জাতীয় কথার কোনোই ভিত্তি নেই। কুরআন-হাদিস ও বিশুদ্ধ বর্ণনা সূত্রে এ ব্যাপারে কেবল এতটুকুই জানা যায়, ইসরা ও মিরাজের ঘটনা এক রাতে সংঘটিত হয়েছিল। ভোর হওয়ার আগেই এই অভূতপূর্ব সফর সমাপ্ত করে তিনি মক্কায় ফিরে এসেছেন। বলা বাহুল্য, মু’মিন মাত্রই বিশ্বাস করবে, আল্লাহর কুদরতে এর চেয়েও কম সময়ে এর চেয়েও দীর্ঘ ও জটিল সফর সমাপ্ত করা অসম্ভব কিছু নয়। আর ইসরা ও মিরাজ তো রাসূলুল্লাহ সা:-এর এক জীবন্ত মুজিজা। এখানে অস্বাভাবিক ঘটনাবলিই ঘটবে- এটিই স্বাভাবিক। কাজেই এ ক্ষেত্রে দিন-ক্ষণ হিসাবের পেছনে পড়া আল্লাহর কুদরত ও রাসূলুল্লাহ সা:-এর মুজিজায় একধরনের সন্দেহ করার শামিল। কারণ ইসরা-মিরাজে যদি ২৭ বছরই লেগে থাকে, তাহলে কুদরত ও রাসূলুল্লাহ সা:-এর মুজিজার বহিঃপ্রকাশ ঘটল কিভাবে? তাই এ জাতীয় প্রমাণহীন কথাবার্তার ব্যাপারে নিচের আয়াতটি স্মরণ করিয়ে দেয়াই যথেষ্ট মনে করি। আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘যে বিষয়ে তোমার ইলম নেই, তার পেছনে পড়ো না।’ (সূরা বনি ইসরাইল-৩৬)
লেখক :
- মুফতি পিয়ার মাহমুদ
ইমাম ও খতিব, মসজিদুল আমান, গাঙ্গিনারপাড়, ময়মনসিংহ