বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সাধারণ যাত্রীদের নিয়ে মেট্রোরেল চলাচল করেছে। বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত উত্তরার উত্তর স্টেশন থেকে আগারগাঁও স্টেশনে ট্রেন চলেছে। প্রথম দিন ৩ হাজার ৮৫৭ জন যাত্রী ট্রেনে চড়েছেন। সেখানে ছিলেন প্রতিবন্ধী, বৃদ্ধ, নারী ও শিশুসহ বিভিন্ন বয়সি মানুষ। কনকনে শীত উপেক্ষা করে মেট্রো স্টেশনে পৌঁছান আগ্রহী নগরবাসী। ভোর থেকে ঘনকুয়াশার মধ্যে শত শত মানুষ মেট্রোতে চড়তে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে শীতে কষ্ট পেলেও তাদের মধ্যে ব্যাপক আনন্দ-উচ্ছ্বাস লক্ষ্য করা গেছে।
তবে তাদের অনেকে আজ ট্রেনে চড়ার কথাও জানান। সকাল ৮টায় ট্রেন ছাড়ার কথা থাকলেও উত্তরা থেকে ট্রেন ছাড়া হয় সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে। ১০ মিনিট ১০ সেকেন্ডে ট্রেনটি পৌঁছানোর কথা থাকলেও প্রথম ছেড়ে আসা ট্রেনটি আগারগাঁও স্টেশনে পৌঁছায় সকাল সাড়ে ৮টায়। আগারগাঁও থেকে উত্তরা স্টেশনের উদ্দেশ্যে প্রথম ট্রেন ছেড়ে যায় ৮টা ৩৮ মিনিটে। সেটি উত্তরা উত্তর স্টেশনে পৌঁছায় সকাল ৮টা ৫২ মিনিটে।
মেট্রোরেলের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) তথ্যমতে, উত্তরা থেকে আগারগাঁও স্টেশনে যে সময়ে ট্রেন পৌঁছানোর কথা তার চেয়ে ৩ থেকে ৫ মিনিট সময় বেশি লেগেছে। টিকিট হারানোর অপরাধে ইমরান হোসেন নামের ঢাকা কলেজের এক শিক্ষার্থীকে ১০০ টাকা জরিমানা করা হয়।
বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৭টায় আগারগাঁও স্টেশনে গিয়ে দেখা যায়, মেট্রোরেলে চড়তে কয়েকশ মানুষের দীর্ঘ লাইন। তখনো টিকিট দেওয়া শুরু করেনি কর্তৃপক্ষ। দ্বিতীয়তলার টিকিট বিক্রির স্থান কনকোর্স হলের প্রধান সার্টার বন্ধ রয়েছে। গণমাধ্যমকর্মীদের ওই সার্টার ধাক্কাধাক্তি করতে দেখা যায়। ৮টা ১৮ মিনিটে ওই শার্টার খুলে দেয় মেট্রোরেলের দায়িত্বপ্রাপ্তরা। আগ্রহীদের কেউ সিঙ্গেল টিকিটের লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কাটেন। সিঙ্গেল টিকিটের লাইনে তেমন কোনো অসুবিধা হয়নি। তবে এমআরটি পাশ দিতে সময় বেশি লাগার কারণে সেটা না দিয়ে মেট্রোরেল কর্মীরা সিঙ্গেল টিকিট বিক্রি করেন।
এমআরটি পাশ না পেয়ে অনেককে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করতে দেখা যায়। তবে সকালে উত্তরা উত্তর স্টেশনের তিনিট কাউন্টারে টিকিট কাটার সময় জটিলতা দেখা দেয়। টাকা গ্রহণ করলে মেশিন থেকে টিকিট মিলছিল না। এজন্য সেখানে দীর্ঘ লাইন তৈরি হয়ে যায়। পরে বিকল্প কাউন্টার থেকে যাত্রীদের টিকিটের ব্যবস্থা করা হয়। সকাল ও দুপুরের দিকে আগারগাঁও স্টেশনের টিকিট মেশিনেও ক্রটি দেখা দেয়। সে কারণে সেখানেও সক্ষমতা অনুযায়ী লাইনে থাকা আগ্রহী যাত্রীদের কাছে টিকিট বিক্রি করতে পারেননি মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ।
মেট্রো স্টেশনের শৃঙ্খলা রক্ষায় রোভার স্কাউট সদস্যদের দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। তারা আগামী তিন মাস দায়িত্ব পালন করবেন বলে জানান।
সরেজমিন দেখা গেছে, উত্তরা উত্তর স্টেশনে শত শত মানুষ টিকিট ক্রয় করছেন। অনেকে দাঁড়িয়ে রয়েছেন লাইনে। কেউ ট্রেনে চড়ে আগারগাঁও থেকে উত্তরা ফিরে প্রিয়জনদের সঙ্গে ছবি তুলতে দেখা গেছে। উপস্থিত সবার মধ্যে খুশির ঝিলিক লক্ষ্য করা গেছে। মেশিনের ত্রুটির কারণে যাদের দীর্ঘসময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে, তারা টিকিট পেয়ে কষ্ট ভুলেছেন। প্রথম দিন হওয়ায় সামান্য ক্রটি-বিচ্যুতি হতে পারে- এটাকে স্বাভাবিকভাবে নিয়েছেন তারা।
উত্তরা থেকে নিয়মিত ঢাকা শিশু হাসপাতালে অফিস করেন চিকিৎসক ফেরদৌসি ও আফিফা ইয়াসমিন। তারা বাসে ও রিকশায় চড়ে উত্তরা থেকে আগারগাঁও শিশু হাসপাতালে চলাচল করেন। এক্ষেত্রে তাদের ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা যাতায়াত খরচ হয়। আসা-যাওয়ায় তাদের সময় লাগে ৩ থেকে সাড়ে ৩ ঘণ্টা। আর মেট্রোতে চড়লে তাদের দৈনিক খরচ হবে ৩০০ টাকা থেকে ৩২০ টাকা। তবে সময় সাশ্রয় হতে পারে ১ থেকে দেড় ঘণ্টা।
মেট্রোরেলের কামরায় তারা যুগান্তরকে জানান, প্রথম দিন তারা ট্রেনে চড়ে অফিস করার পরিকল্পনা নেন। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী সকাল সাড়ে ৮টায় উত্তরা উত্তর স্টেশনে পৌঁছান। দীর্ঘ লাইন মাড়িয়ে টিকিট হাতে পান ১০টায়। এরপর ১৫ মিনিটে আগারগাঁও স্টেশনে পৌঁছান। স্বাভাবিক দিনের চেয়ে তাদের আগারগাঁও পৌঁছতে বেশি সময় লেগেছে। মেট্রোরেলের চলাচল স্বাভাবিক হলে এটা ঠিক হবে বলে আশাবাদ তাদের।
মিরপুর-১১ নম্বর বাংলা স্কুলের শিক্ষক আজিজুল ইসলাম জানান, সকাল ৬টার আগেই আমরা ৩ শিক্ষক বন্ধু আগারগাঁও স্টেশনে হাজির হই। এত ভোরে এসে দেখি আমাদের আগে দুইশর মতো লোক লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। এ অবস্থায় টিকিট কাটি। এতে জনপ্রতি ৫-৭ মিনিটের মতো সময় লেগেছে। কাউন্টারে যারা দায়িত্বে রয়েছেন তারা একটু সময় নিয়ে টিকিট কাটেন। মনে হয় কম্পিউটার চালানোর বিষয়ে তারা দক্ষ না। আগারগাঁও থেকে উত্তরা পর্যন্ত কয়েক দফা ভ্রমণ করি। সবাই খুব আবেগপ্রবণ ছিলাম। মেট্রোতে উঠার প্রথম অভিজ্ঞতা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। ইতিহাসের সাক্ষী হতে পেরে নিজেকে খুবই গর্ববোধ করি।
‘হুইলচেয়ার ক্রিকেট’ দলের অধিনায়ক মোহাম্মদ মহসীন উত্তরা স্টেশন হয়ে মেট্রোরেলে চড়েছেন। এ সময় হুইলচেয়ার ব্যবহার করে লিফটে চড়ে মেট্রো ট্রেনে চড়েছেন তিনি। মেট্রো ট্রেনে চড়ার পর সাংবাদিকদের জানান, দেশের বিদ্যমান গণপরিবহণে প্রতিবন্ধীদের চলাচলের সুযোগ কম। সবার কথা বিবেচনা করে মেট্রো ট্রেন চালু করায় আমি সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। প্রথম দিন মেট্রো ট্রেনে চড়তে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি।
দীর্ঘ লাইন এবং মেশিন সমস্যার কারণে তাড়াতাড়ি টিকিট কাটতে পারবেন না বুঝতে পেরে ফেরত যান শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থী এবং কয়েকজন শিক্ষক। তাদের একজন মোহাম্মদ রনি যুগান্তরকে জানান, এতবড় লাইন শেষ হতে অনেক সময় লাগবে। তাছাড়া টিকিট মেশিন বিকল। তাই আজকে (বৃহস্পতিবার) আর হবে না। আমরা যেহেতু পাশেই থাকি যে কোনো সময় ভ্রমণ করতে পারব। তাই ফেরত যাচ্ছি।
এদিকে মেট্রোরেলের প্রথম সমস্যাগুলোকে বাঁকা চোখে না দেখার অনুরোধ জানিয়েছেন সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। আজ সচিবালয়ে নিজের দপ্তরে সাংবাদিকদের বলেছেন, ঢাকায় যে মেট্রোরেল হয়েছে, সেটা কলকাতার মেট্রোর চেয়ে অনেক অগ্রসর। সাধারণ নাগরিকদের নিয়ে মেট্রোরেল চলাচলের প্রথম দিন ছোটোখাটো যেসব সমস্যা হয়েছে, সময় গেলে সবাই অভ্যস্ত হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
জানতে চাইলে ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন সিদ্দিক যুগান্তরকে বলেন, সিঙ্গেল টিকিটের বেশি চাপ থাকায় আজ সকালে এমআরটি পাশ বিক্রি বন্ধ করা হয়। তাৎক্ষণিক এ সিদ্ধান্ত টেলিভিশনেও প্রচার করা হয়েছে। সকালে বিক্রি বন্ধ করে আমরা বিকাল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিই। উত্তরা ও আগারগাঁও দুই স্টেশনেই এমআরটি পাশ বিক্রি করা হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে অনলাইন থেকে ফরমপূরণ করে আসলে তিনি নিবন্ধিত থাকবেন। এমআরটি-৬ বা মেট্রোরেলের বিভিন্ন আপডেট তথ্য পেয়ে যাবেন। আর যারা ফরমপূরণ না করে এমআরটি পাশ কিনবেন তারা নিবন্ধনের সুবিধা পাবেন না।