ঢাকা , মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

কেএনএফ-এর শক্তি মূলত কতটা?

  • সূর্যোদয় ডেস্ক:
  • আপডেট সময় ১০:২৮:৪৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৬ এপ্রিল ২০২৪
  • ১১০৬ বার পড়া হয়েছে

বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে দুটি ব্যাংকের তিনটি শাখায় ডাকাতির ঘটনায় নতুন করে আলোচনায় আসা সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফ-এর বিরুদ্ধে এলিট ফোর্স র্যাব সাঁড়াশি অভিযানের ঘোষণা দিয়েছে।

শুক্রবার (৫ এপ্রিল) থেকেই সাঁড়াশি অভিযানের ঘোষণা দিয়ে এলিট ফোর্স র্যাব বলেছে সে অভিযানে ‘পাহাড়ে উগ্রবাদী বিরোধী অভিযানের মতো সব ধরনের কৌশল’ প্রয়োগ করা হবে।

স্থানীয় পুলিশ জানিয়েছে, তারা মনে করছে থানচিতে প্রকাশ্য দিবালোকে বাজার ঘিরে দুটি ব্যাংকের শাখায় হামলাকারী সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা থানারই দেড় থেকে দুই কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থান করে থাকতে পারে।

তবে বৃহস্পতিবার গভীর রাতে আলীকদম উপজেলায় যে গোলাগুলির খবর এসেছে সেটি কোনো চেকপোস্টে হামলার ঘটনা ছিল না বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।

২০২২ সালে পার্বত্য এলাকায় ‘উগ্রবাদী বিরোধী’ একটি সমন্বিত অভিযান চালিয়েছিলো নিরাপত্তা বাহিনী। তখন কেএনএফ বিরুদ্ধে ‘উগ্রবাদী সংগঠন’ জামাতুল আনসার ফিল হিন্দিল শারক্বীয়া সদস্যদের দুর্গম পাহাড়ে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়ার অভিযোগ করা হয়েছিল। ওই অভিযানের পর কেএনএফের সশস্ত্র তৎপরতা খুব একটা দৃশ্যমান ছিল না।

এদিকে মঙ্গলবার রাতে রুমায় সোনালী ব্যাংকে ও বুধবার দুপুরে থানচি বাজারে সোনালি ও কৃষি ব্যাংকের শাখায় হামলার ঘটনার পর শুক্রবার অনেক মানুষকেই থানচি ছাড়তে দেখা গেছে। রুমা, থানচি ও রোয়াংছড়িসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে নিরাপত্তা বাহিনীর শক্তি বাড়ানো হয়েছে।

তবে থানচি গিয়ে চট্টগ্রাম পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি সঞ্জয় সরকার মানুষজনকে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, এখন যে পরিস্থিতি আছে তা সামাল দেয়ার সক্ষমতা পুলিশের আছে।

ওদিকে ব্যাংকে হামলা, কর্মকর্তা অপহরণ ও অস্ত্র লুটের ঘটনায় রুমা ও থানচি থানায় শুক্রবার মোট ছয়টি মামলা হয়েছে বলে পুলিশ নিশ্চিত করেছে।

কেএনএফ কতটা শক্তিশালী
রুমা ও থানচিতে হামলার ঘটনার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ওই ঘটনার জন্য কেএনএফকে অভিযুক্ত করেছেন। তবে কেএনএফের দিক থেকে এখনো এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য আসেনি।

কেএনএফ বা কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন’ হিসেবেই বিবেচনা করে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী।

থানচি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জসিম উদ্দিন শুক্রবার সন্ধ্যায় বলেছেন, তাদের ধারণা থানচিতে হামলাকারী সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা থানার দেড়-দুই কিলোমিটারের মধ্যেই অবস্থান করছে।

তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে যা বুঝতে পারছি তাতে আমাদের মনে হয় আশেপাশের পাহাড়েই তারা আছে। তবে তাদের এমন কোনো শক্তি নেই যে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে হবে। একটা পরিস্থিতি হয়েছে সেটি মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।’

কিন্তু তারপরও হুট করে ব্যাংকে হামলা করে টাকা ও অস্ত্র লুটের ঘটনার পর প্রশ্ন উঠছে কেএনএফ-এর শক্তি মূলত কতটা এবং তারা কোনো ধরনের আঞ্চলিক আশীর্বাদ পাচ্ছে কি না।

বান্দরবানে এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন বলেছেন তারা মনে করেন, গত কয়েক দিনে ব্যাংক ডাকাতি ও অস্ত্র লুটের ঘটনার দুইটি উদ্দেশ্য থাকতে পারে।

তিনি বলেন, ‘প্রথমত, টাকা লুটপাট ও অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়া এবং দ্বিতীয়ত নিজেদের সক্ষমতা প্রদর্শন করা।’

কিন্তু এই সক্ষমতা বলতে কেএনএফের শক্তি বা সামর্থ্যের কথা বোঝানো হলে এই প্রশ্নও আসে যে প্রকৃত অর্থে কতটা শক্তিশালী এই কেএনএফ।

গত প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বান্দরবানের শান্তি আলোচনা বিষয়ে কেএনএফ-এর বিভিন্ন সূত্রের সাথে যাদের যোগাযোগ হয়েছিল। তাদের কয়েকজন ধারণা দিয়েছেন যে কেএনএফ-এর সামরিক শাখার সদস্য সংখ্যা ৩৫০ থেকে ৪০০ মতো হতে পারে।

একসময় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে শুরু করা কেএনএফ ২০২২ সালের শেষ দিকে বেশ সক্রিয় ছিল ফেসবুকে। তখন ফেসবুকে ও ইউটিউব পোস্টে কেএনএফ তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ ছাড়াও শুরু থেকেই সরকার ও জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিয়েছিল।

তারও আগে তারা ফেসবুকে জানিয়েছিল যে তাদের একটি কমান্ডো দলও আছে যার নাম – হেড হান্টার কমান্ডো টিম।

ওই বছরের জুলাই মাসে ফেসবুকে কেএনএফ জানায়, তাদেরে একদল কমান্ডো মিয়ানমারের কাচিন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে এসেছে। এরপর অগাস্টে সামরিক পোশাক পরিহিত একদল ব্যক্তির ছবি দিয়ে কেএনএফ দাবি করে এরা তাদের কমান্ডো।

পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) এমদাদুল ইসলামের।

ইসলাম বলছেন, কেএনএফের শক্তি ও সমর্থন খুব একটা আছে তেমনটা তিনি মনে করেন না।

তিনি বলেন, ‘তবে আমার মনে হয় তাদের যথাযথ গুরুত্ব না দেয়ায় তারা একটু বড় হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। পরে উগ্রবাদী ইস্যুটি সামনে আসার পর কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে এসেছে। আবার কেএনএফ আলোচনায় আসায় হয়তো আত্মতুষ্টি তৈরি হয়েছে। সেই সুযোগেই এবারের ঘটনা ঘটেছে।’

তবে কেউ কেউ আবার মনে করেন বান্দরবানের শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সাথে আলোচনায় আসার কারণে কেএনএফ-এর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বও এবারের হামলার একটি কারণ হতে পারে।

ইসলাম বলেন, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর মধ্যে এটা দেখা যায় বিশ্বজুড়েই। মূল নেতৃত্ব সরকারের সাথে আলোচনায় যেতে চাইলে পরবর্তী ধাপ বা অন্য স্তর থেকে আঘাত আসে। তারা হয়তোভাবে সমঝোতা হয়ে গেলে তাদের আর অর্জন কী থাকলো।’

তার মতে রুমা ও থানচির ঘটনায় সেটিও একটি কারণ হতে পারে।

বান্দরবানের শান্তি আলোচনার সাথে ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র বলছে তাদের ধারণা এই শান্তি আলোচনাকে ঘিরে কেএনএফ-এর সামরিক ও রাজনৈতিক শাখার মধ্যে বিরোধ তৈরি হতে পারে। তবে এরও কোনো প্রমাণ নেই।

আঞ্চলিক আশীর্বাদ থাকতে পারে কি না?
কেএনএফ-এর সাথে ভারতের মিজোরাম ও মিয়ানমারের কুকিদের সাথে যোগসূত্রের কথা শোনা গেলেও তার দৃশ্যমান প্রমাণ খুব একটা দেখা যায় না। আবার আরাকাম আর্মির সাথেও কেএনএফ-এর সখ্য সহজ নয় কারণ ঐতিহাসিকভাবেই কুকি ও মগদের মধ্যে বন্ধুত্বের চেয়ে সংঘর্ষই হয়েছে বেশি।

মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) এমদাদুল ইসলাম বলছেন, মিজোরামে বম জনগোষ্ঠীর অবস্থান আছে তবে কেএনএফ তাদের আশীর্বাদ পাচ্ছে, বাংলাদেশে এসব করার জন্য, তেমনটা মনে হয় না।

তিনি বলেন, ‘মিজোদের সাথে এখানকার বমদের মিল আছে। কেএনএফের শীর্ষস্থানীয় কেউ কেউ সেখানেও যেতেও পারেন। আবার মিয়ানমারের আরাকান আর্মিও তাদের ব্যবহার করতে পারে বা যোগসূত্র তৈরি করতে পারে। কিন্তু এগুলো এখনো নিছক ধারণাই।’

তবে বান্দরবানের কয়েকটি সূত্র বলছে, কেএনএফ এর মূল কেন্দ্র হলো বাংলাদেশ, ভারত ও মায়ানমারের সীমান্ত ট্রায়াঙ্গল।

সেখানেই জিরো পয়েন্টে তাদের অবস্থান এবং তারা বাংলাদেশের ভেতরেই সক্রিয় থেকে কাজ করে বলে দাবি করেছে এমন কয়েকটি সূত্র।

এসব সূত্রের দাবি ২০২২ সালে পাহাড়ে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানের পর থেকে কেএনএফ বড় ধরনের অর্থ সংকটে পড়ে যায়। সে কারণেই সংগঠনটির একটি অংশ ব্যাংক ডাকাতির পরিকল্পনা করে থাকতে পারে।

তা না হলে অন্য কোনো বিষয়ে অসন্তোষ থাকলে সেটি কেএনএফ এর দিক থেকে আগামী ২২ এপ্রিল তৃতীয় সরাসরি আলোচনায় তুলে ধরার সুযোগ ছিল।

আলীকদমে রাতে কী হয়েছিল
বৃহস্পতিবার রাতে প্রথমে থানচি বাজার এলাকায় কেএনএফের সাথে এক ঘণ্টার মতো গোলাগুলির খবর নিশ্চিত করেছিল পুলিশ। পরে রাত একটার দিকে আলীকদমে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর চেকপোস্টে হামলার খবর আসে।

পরে প্রশাসন থেকে বলা হয় চেকপোস্টে হামলা হয়নি এবং এটি একটি ভুল বুঝাবুঝির ঘটনা।

আলীকদম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আতাউল গণি ওসমানি বলেছেন, বৃহস্পতিবার রাতে থানচি আলীকদম সীমান্তের আলীকদম সড়কের ব্যারিকেড এলাকায় একটি বালু পরিবহনের ট্রাককে কেন্দ্র করে গুলির ঘটনা ঘটে।

তিনি বলেন, ‘ট্রাকটি সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। চেকপোস্টে হামলা বা আলীকদমে কোনো হামলার ঘটনা ঘটেনি। উঁচু সড়কের ওই স্থানে বাঁশের ব্যারিকেড ছিল। ব্যারিকেড অতিক্রম করলে পুলিশ গুলি করে। এছাড়া আর্মি, পুলিশ ও বিজিবি মুভ করার পর আর কোনো তৎপরতাও দেখা যায়নি।’

যদিও ওই সময় কয়েকশ রাউন্ড গুলির শব্দ শোনা গেছে বলে খবর এসেছে এবং পুলিশের পজিশন নেয়ার ছবি সামাজিক ও গণমাধ্যমে এসেছে।

কেউ কেউ ধারণা করছিলো যে তিন্দু হয়ে রেমাক্রির দিকে যাওয়া কিংবা পাহাড় থেকে নেমে লামার দিকে যাওয়ার জন্যই থানচিতে হামলাকারী বন্দুকধারীদের একটি অংশ থানচি আলীকদম সীমান্তের ওই চেকপোস্টের কাছ দিয়ে যাচ্ছিল।

থানচি আলী কদম সড়কটি মূলত নির্জন পাহাড়ের ওপর দেশের সবচেয়ে উঁচুতে তৈরি করা সড়ক। আর সেই পথ হয়ে গেলে রেমাক্রি বা লামার দিকে দুর্গম পাহাড়ের ওই অংশে নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি সাধারণত কম থাকে।

ওসমানী বলছেন, আলীকদম উপজেলাকে তারা এখন পর্যন্ত নিরাপদ বলেই মনে করছেন।

আলীকদম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তবিদুর রহমান বলছেন, আলীকদমের যে ভৌগলিক অবস্থান তাতে এ ধরনের হামলার সুযোগ সেখানে খুব একটা নেই বলেই আমরা মনে করি।

তিনি বলেন, ‘একটা গাড়ি এসেছিল। চেকপোস্টের ব্যারিকেডে পড়েছিল। আবার থানচির দিকে চলে গেছে।’

সর্বশেষ পরিস্থিতি কেমন
বৃহস্পতিবার রাতের গোলাগুলির পর থানচি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জসিম উদ্দিনও মনে করছেন যে বন্দুকধারীরা থানচি এলাকাতেই অবস্থান করছে।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন থানচি বাজারে আজও লোকজন দেখা যায়নি খুব একটা। অনেকে পরিবারের নারী ও শিশুদের অন্যত্র পাঠিয়ে দিচ্ছেন এমন দৃশ্য দেখা গেছে। সকালে থানচিতে সেনা টহল দেখা গেছে। এছাড়া বিজিবিকেও টহলরত দেখা গেছে।

এর মধ্যেই সব দোকানপাট খুলেনি।

থানচি বাজারের ২-৩ শ’ গজের ভেতরেই রয়েছে থানচি থানা, একটি বিজিবি ক্যাম্প এবং বাজারের শেষ মাথায় রয়েছে সেনাবাহিনীর একটি চেকপোস্ট।

থানচিতে গিয়ে শুক্রবার পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি সঞ্জয় সরকার বলেছেন লোকজনের ভীত হওয়ার কোনো কারণ নেই।

তিনি বলেন, ‘এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় পুলিশের সক্ষমতা আছে। তাই উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।’

পাশাপাশি দুপুরেই বান্দরবানে সংবাদ সম্মেলন করে র্যাব জানায় যে আজ থেকেই কেএনএফ-এর বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করবে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ।

সূত্র : বিবিসি

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

আজকের সূর্যোদয়

আজকের সূর্যোদয় প্রত্রিকায় আপনাদের স্বাগতম। ‍আমাদের নিউজ পড়ুন এবং বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদের পাশে থাকুন।

বরিশালে মুজিবিয়ানের ৮৭ নেতাকে খুঁজছে গোয়েন্দা সংস্থা

কেএনএফ-এর শক্তি মূলত কতটা?

আপডেট সময় ১০:২৮:৪৯ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৬ এপ্রিল ২০২৪

বান্দরবানের রুমা ও থানচিতে দুটি ব্যাংকের তিনটি শাখায় ডাকাতির ঘটনায় নতুন করে আলোচনায় আসা সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফ-এর বিরুদ্ধে এলিট ফোর্স র্যাব সাঁড়াশি অভিযানের ঘোষণা দিয়েছে।

শুক্রবার (৫ এপ্রিল) থেকেই সাঁড়াশি অভিযানের ঘোষণা দিয়ে এলিট ফোর্স র্যাব বলেছে সে অভিযানে ‘পাহাড়ে উগ্রবাদী বিরোধী অভিযানের মতো সব ধরনের কৌশল’ প্রয়োগ করা হবে।

স্থানীয় পুলিশ জানিয়েছে, তারা মনে করছে থানচিতে প্রকাশ্য দিবালোকে বাজার ঘিরে দুটি ব্যাংকের শাখায় হামলাকারী সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা থানারই দেড় থেকে দুই কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থান করে থাকতে পারে।

তবে বৃহস্পতিবার গভীর রাতে আলীকদম উপজেলায় যে গোলাগুলির খবর এসেছে সেটি কোনো চেকপোস্টে হামলার ঘটনা ছিল না বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।

২০২২ সালে পার্বত্য এলাকায় ‘উগ্রবাদী বিরোধী’ একটি সমন্বিত অভিযান চালিয়েছিলো নিরাপত্তা বাহিনী। তখন কেএনএফ বিরুদ্ধে ‘উগ্রবাদী সংগঠন’ জামাতুল আনসার ফিল হিন্দিল শারক্বীয়া সদস্যদের দুর্গম পাহাড়ে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেয়ার অভিযোগ করা হয়েছিল। ওই অভিযানের পর কেএনএফের সশস্ত্র তৎপরতা খুব একটা দৃশ্যমান ছিল না।

এদিকে মঙ্গলবার রাতে রুমায় সোনালী ব্যাংকে ও বুধবার দুপুরে থানচি বাজারে সোনালি ও কৃষি ব্যাংকের শাখায় হামলার ঘটনার পর শুক্রবার অনেক মানুষকেই থানচি ছাড়তে দেখা গেছে। রুমা, থানচি ও রোয়াংছড়িসহ গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে নিরাপত্তা বাহিনীর শক্তি বাড়ানো হয়েছে।

তবে থানচি গিয়ে চট্টগ্রাম পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি সঞ্জয় সরকার মানুষজনকে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, এখন যে পরিস্থিতি আছে তা সামাল দেয়ার সক্ষমতা পুলিশের আছে।

ওদিকে ব্যাংকে হামলা, কর্মকর্তা অপহরণ ও অস্ত্র লুটের ঘটনায় রুমা ও থানচি থানায় শুক্রবার মোট ছয়টি মামলা হয়েছে বলে পুলিশ নিশ্চিত করেছে।

কেএনএফ কতটা শক্তিশালী
রুমা ও থানচিতে হামলার ঘটনার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ওই ঘটনার জন্য কেএনএফকে অভিযুক্ত করেছেন। তবে কেএনএফের দিক থেকে এখনো এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য আসেনি।

কেএনএফ বা কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন’ হিসেবেই বিবেচনা করে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী।

থানচি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জসিম উদ্দিন শুক্রবার সন্ধ্যায় বলেছেন, তাদের ধারণা থানচিতে হামলাকারী সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা থানার দেড়-দুই কিলোমিটারের মধ্যেই অবস্থান করছে।

তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে যা বুঝতে পারছি তাতে আমাদের মনে হয় আশেপাশের পাহাড়েই তারা আছে। তবে তাদের এমন কোনো শক্তি নেই যে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে হবে। একটা পরিস্থিতি হয়েছে সেটি মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।’

কিন্তু তারপরও হুট করে ব্যাংকে হামলা করে টাকা ও অস্ত্র লুটের ঘটনার পর প্রশ্ন উঠছে কেএনএফ-এর শক্তি মূলত কতটা এবং তারা কোনো ধরনের আঞ্চলিক আশীর্বাদ পাচ্ছে কি না।

বান্দরবানে এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন বলেছেন তারা মনে করেন, গত কয়েক দিনে ব্যাংক ডাকাতি ও অস্ত্র লুটের ঘটনার দুইটি উদ্দেশ্য থাকতে পারে।

তিনি বলেন, ‘প্রথমত, টাকা লুটপাট ও অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়া এবং দ্বিতীয়ত নিজেদের সক্ষমতা প্রদর্শন করা।’

কিন্তু এই সক্ষমতা বলতে কেএনএফের শক্তি বা সামর্থ্যের কথা বোঝানো হলে এই প্রশ্নও আসে যে প্রকৃত অর্থে কতটা শক্তিশালী এই কেএনএফ।

গত প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বান্দরবানের শান্তি আলোচনা বিষয়ে কেএনএফ-এর বিভিন্ন সূত্রের সাথে যাদের যোগাযোগ হয়েছিল। তাদের কয়েকজন ধারণা দিয়েছেন যে কেএনএফ-এর সামরিক শাখার সদস্য সংখ্যা ৩৫০ থেকে ৪০০ মতো হতে পারে।

একসময় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে শুরু করা কেএনএফ ২০২২ সালের শেষ দিকে বেশ সক্রিয় ছিল ফেসবুকে। তখন ফেসবুকে ও ইউটিউব পোস্টে কেএনএফ তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ ছাড়াও শুরু থেকেই সরকার ও জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিয়েছিল।

তারও আগে তারা ফেসবুকে জানিয়েছিল যে তাদের একটি কমান্ডো দলও আছে যার নাম – হেড হান্টার কমান্ডো টিম।

ওই বছরের জুলাই মাসে ফেসবুকে কেএনএফ জানায়, তাদেরে একদল কমান্ডো মিয়ানমারের কাচিন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে এসেছে। এরপর অগাস্টে সামরিক পোশাক পরিহিত একদল ব্যক্তির ছবি দিয়ে কেএনএফ দাবি করে এরা তাদের কমান্ডো।

পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) এমদাদুল ইসলামের।

ইসলাম বলছেন, কেএনএফের শক্তি ও সমর্থন খুব একটা আছে তেমনটা তিনি মনে করেন না।

তিনি বলেন, ‘তবে আমার মনে হয় তাদের যথাযথ গুরুত্ব না দেয়ায় তারা একটু বড় হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। পরে উগ্রবাদী ইস্যুটি সামনে আসার পর কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে এসেছে। আবার কেএনএফ আলোচনায় আসায় হয়তো আত্মতুষ্টি তৈরি হয়েছে। সেই সুযোগেই এবারের ঘটনা ঘটেছে।’

তবে কেউ কেউ আবার মনে করেন বান্দরবানের শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সাথে আলোচনায় আসার কারণে কেএনএফ-এর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বও এবারের হামলার একটি কারণ হতে পারে।

ইসলাম বলেন, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর মধ্যে এটা দেখা যায় বিশ্বজুড়েই। মূল নেতৃত্ব সরকারের সাথে আলোচনায় যেতে চাইলে পরবর্তী ধাপ বা অন্য স্তর থেকে আঘাত আসে। তারা হয়তোভাবে সমঝোতা হয়ে গেলে তাদের আর অর্জন কী থাকলো।’

তার মতে রুমা ও থানচির ঘটনায় সেটিও একটি কারণ হতে পারে।

বান্দরবানের শান্তি আলোচনার সাথে ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র বলছে তাদের ধারণা এই শান্তি আলোচনাকে ঘিরে কেএনএফ-এর সামরিক ও রাজনৈতিক শাখার মধ্যে বিরোধ তৈরি হতে পারে। তবে এরও কোনো প্রমাণ নেই।

আঞ্চলিক আশীর্বাদ থাকতে পারে কি না?
কেএনএফ-এর সাথে ভারতের মিজোরাম ও মিয়ানমারের কুকিদের সাথে যোগসূত্রের কথা শোনা গেলেও তার দৃশ্যমান প্রমাণ খুব একটা দেখা যায় না। আবার আরাকাম আর্মির সাথেও কেএনএফ-এর সখ্য সহজ নয় কারণ ঐতিহাসিকভাবেই কুকি ও মগদের মধ্যে বন্ধুত্বের চেয়ে সংঘর্ষই হয়েছে বেশি।

মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) এমদাদুল ইসলাম বলছেন, মিজোরামে বম জনগোষ্ঠীর অবস্থান আছে তবে কেএনএফ তাদের আশীর্বাদ পাচ্ছে, বাংলাদেশে এসব করার জন্য, তেমনটা মনে হয় না।

তিনি বলেন, ‘মিজোদের সাথে এখানকার বমদের মিল আছে। কেএনএফের শীর্ষস্থানীয় কেউ কেউ সেখানেও যেতেও পারেন। আবার মিয়ানমারের আরাকান আর্মিও তাদের ব্যবহার করতে পারে বা যোগসূত্র তৈরি করতে পারে। কিন্তু এগুলো এখনো নিছক ধারণাই।’

তবে বান্দরবানের কয়েকটি সূত্র বলছে, কেএনএফ এর মূল কেন্দ্র হলো বাংলাদেশ, ভারত ও মায়ানমারের সীমান্ত ট্রায়াঙ্গল।

সেখানেই জিরো পয়েন্টে তাদের অবস্থান এবং তারা বাংলাদেশের ভেতরেই সক্রিয় থেকে কাজ করে বলে দাবি করেছে এমন কয়েকটি সূত্র।

এসব সূত্রের দাবি ২০২২ সালে পাহাড়ে নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানের পর থেকে কেএনএফ বড় ধরনের অর্থ সংকটে পড়ে যায়। সে কারণেই সংগঠনটির একটি অংশ ব্যাংক ডাকাতির পরিকল্পনা করে থাকতে পারে।

তা না হলে অন্য কোনো বিষয়ে অসন্তোষ থাকলে সেটি কেএনএফ এর দিক থেকে আগামী ২২ এপ্রিল তৃতীয় সরাসরি আলোচনায় তুলে ধরার সুযোগ ছিল।

আলীকদমে রাতে কী হয়েছিল
বৃহস্পতিবার রাতে প্রথমে থানচি বাজার এলাকায় কেএনএফের সাথে এক ঘণ্টার মতো গোলাগুলির খবর নিশ্চিত করেছিল পুলিশ। পরে রাত একটার দিকে আলীকদমে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর চেকপোস্টে হামলার খবর আসে।

পরে প্রশাসন থেকে বলা হয় চেকপোস্টে হামলা হয়নি এবং এটি একটি ভুল বুঝাবুঝির ঘটনা।

আলীকদম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আতাউল গণি ওসমানি বলেছেন, বৃহস্পতিবার রাতে থানচি আলীকদম সীমান্তের আলীকদম সড়কের ব্যারিকেড এলাকায় একটি বালু পরিবহনের ট্রাককে কেন্দ্র করে গুলির ঘটনা ঘটে।

তিনি বলেন, ‘ট্রাকটি সেখান দিয়ে যাচ্ছিল। চেকপোস্টে হামলা বা আলীকদমে কোনো হামলার ঘটনা ঘটেনি। উঁচু সড়কের ওই স্থানে বাঁশের ব্যারিকেড ছিল। ব্যারিকেড অতিক্রম করলে পুলিশ গুলি করে। এছাড়া আর্মি, পুলিশ ও বিজিবি মুভ করার পর আর কোনো তৎপরতাও দেখা যায়নি।’

যদিও ওই সময় কয়েকশ রাউন্ড গুলির শব্দ শোনা গেছে বলে খবর এসেছে এবং পুলিশের পজিশন নেয়ার ছবি সামাজিক ও গণমাধ্যমে এসেছে।

কেউ কেউ ধারণা করছিলো যে তিন্দু হয়ে রেমাক্রির দিকে যাওয়া কিংবা পাহাড় থেকে নেমে লামার দিকে যাওয়ার জন্যই থানচিতে হামলাকারী বন্দুকধারীদের একটি অংশ থানচি আলীকদম সীমান্তের ওই চেকপোস্টের কাছ দিয়ে যাচ্ছিল।

থানচি আলী কদম সড়কটি মূলত নির্জন পাহাড়ের ওপর দেশের সবচেয়ে উঁচুতে তৈরি করা সড়ক। আর সেই পথ হয়ে গেলে রেমাক্রি বা লামার দিকে দুর্গম পাহাড়ের ওই অংশে নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি সাধারণত কম থাকে।

ওসমানী বলছেন, আলীকদম উপজেলাকে তারা এখন পর্যন্ত নিরাপদ বলেই মনে করছেন।

আলীকদম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তবিদুর রহমান বলছেন, আলীকদমের যে ভৌগলিক অবস্থান তাতে এ ধরনের হামলার সুযোগ সেখানে খুব একটা নেই বলেই আমরা মনে করি।

তিনি বলেন, ‘একটা গাড়ি এসেছিল। চেকপোস্টের ব্যারিকেডে পড়েছিল। আবার থানচির দিকে চলে গেছে।’

সর্বশেষ পরিস্থিতি কেমন
বৃহস্পতিবার রাতের গোলাগুলির পর থানচি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জসিম উদ্দিনও মনে করছেন যে বন্দুকধারীরা থানচি এলাকাতেই অবস্থান করছে।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন থানচি বাজারে আজও লোকজন দেখা যায়নি খুব একটা। অনেকে পরিবারের নারী ও শিশুদের অন্যত্র পাঠিয়ে দিচ্ছেন এমন দৃশ্য দেখা গেছে। সকালে থানচিতে সেনা টহল দেখা গেছে। এছাড়া বিজিবিকেও টহলরত দেখা গেছে।

এর মধ্যেই সব দোকানপাট খুলেনি।

থানচি বাজারের ২-৩ শ’ গজের ভেতরেই রয়েছে থানচি থানা, একটি বিজিবি ক্যাম্প এবং বাজারের শেষ মাথায় রয়েছে সেনাবাহিনীর একটি চেকপোস্ট।

থানচিতে গিয়ে শুক্রবার পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি সঞ্জয় সরকার বলেছেন লোকজনের ভীত হওয়ার কোনো কারণ নেই।

তিনি বলেন, ‘এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় পুলিশের সক্ষমতা আছে। তাই উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।’

পাশাপাশি দুপুরেই বান্দরবানে সংবাদ সম্মেলন করে র্যাব জানায় যে আজ থেকেই কেএনএফ-এর বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করবে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ।

সূত্র : বিবিসি