বাংলাদেশ ভারতকে সম্প্রতি রেল, সড়ক বা নদীপথেও নানাভাবে ট্রানজিট সুবিধা দিয়েছে। এখন সম্পূর্ণ নতুন একটি রুটে দু’দেশের মধ্যে সড়ক সংযোগের দাবি উঠে এসেছে ভারতে জলপাইগুড়ি কেন্দ্রের নির্বাচনী প্রচারে।
ঢাকা-দিল্লির মধ্যে কূটনৈতিক স্তরে এই করিডোর নিয়ে আগে কখনোই তেমন আলোচনা শোনা যায়নি। কিন্তু আপাতত এই তেঁতুলিয়া করিডোরের দাবিতেই সরব এমনিতে নিস্তরঙ্গ জলপাইগুড়ির ওই সীমান্ত এলাকা।
ফলে বাংলাদেশের উত্তরতম প্রান্তে তেঁতুলিয়ার বুক চিরে মাত্র সোয়া চার কিলোমিটার রাস্তার ওপর অধিকারের দাবিকে ঘিরে জোরাল প্রচারণা চলেছে সংলগ্ন ভারতের জলপাইগুড়ি কেন্দ্রে।
সেখানে ভোট হবে শুক্রবার (১৯ এপ্রিল), ভারতে নির্বাচনের প্রথম দফাতেই।
ভারতীয়দের কাছে এই প্রস্তাবিত রুটের পোশাকি নাম ‘তেঁতুলিয়া করিডোর’, যে পথে চলাচলের অধিকার পেলে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলে একটা বিস্তীর্ণ অংশের মানুষের কলকাতা যাতায়াত করাটা অনেক সহজ হয়ে যাবে।
এখন রাজগঞ্জ, মেখলিগঞ্জসহ একটা বড় এলাকার মানুষকে শিলিগুড়ি হয়ে বহু ঘুরপথে রাজ্যের রাজধানী কলকাতায় যেতে হয়।
কিন্তু বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে মাত্র সোয়া চার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারলে সেই দূরত্বটা প্রায় এক শ’ কিলোমিটার কমে যাবে। সময় ও খরচ বাঁচবে প্রচুর, রাস্তায় শিলিগুড়ির মতো ব্যস্ত শহরকেও এড়িয়ে যাওয়া যাবে।
এ জন্যই দীর্ঘ দিন ধরে বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে এই ‘করিডোরে’র অধিকার বা ‘রাইট টু প্যাসেজ’ চাইছে সেখানকার লাখ লাখ মানুষ।
বাংলাদেশ কেন নিজের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেবে?
ভারতে ক্ষমতাসীন দল বিজেপির জলপাইগুড়ি আসনের প্রার্থী প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন, তারা আবার জিতে ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশের কাছ থেকে এ করিডোরের অধিকার আদায় করেই দেখাবেন।
তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থীর পাল্টা প্রশ্ন, বিজেপি তো গত ১০ বছর ধরেই দেশের ক্ষমতায়, তাহলে এত দিনেও এ করিডারের অধিকার বাস্তবায়িত হয়নি কেন?
কিন্তু এই দাবি ও পাল্টা দাবির মধ্যেও যে গুরুতর প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে, বাংলাদেশই বা কেন তাদের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভারতীয়দের এই বাড়তি সুবিধাটা দিতে যাবে?
জলপাইগুড়ির সীমান্ত এলাকার মানুষজন অবশ্য এক বাক্যে বলছে, যেভাবে ভারত বহুকাল আগে থেকেই বাংলাদেশকে ‘তিনবিঘা করিডোর’ ব্যবহার করতে দিচ্ছে এবং হালে ওই এলাকায় বাংলাদেশ-ভারত রেল সংযোগও আবার নতুন করে স্থাপিত হয়েছে, তাতে এই ‘সামান্য’ সুবিধাটুকু দিয়ে বাংলাদেশ পাল্টা সৌজন্য দেখাতেই পারে!’
কূটনীতির অঙ্ক অবশ্যই এত সহজ নিয়মে চলে না।
বিষয়টির সাথে বাংলাদেশের ‘টেরিটোরিয়াল ইন্টিগ্রিটি’ বা ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নও জড়িত। কাজেই যত সহজে দাবিটি জানানো হচ্ছে তত সহজে এটি পূরণ হবে বলে আদৌ মনে হয় না।
কিন্তু আপাতত জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলার একটা বড় অংশে ভোটের রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে এই তেঁতুলিয়া করিডোরের দাবিকে ঘিরেই।
সেটা ঠিক কিভাবে, তা সরেজমিনে দেখতেই পাড়ি দিয়েছিলাম জলপাইগুড়ি জেলার প্রত্যন্ত ওই সব সীমান্ত এলাকায়।
কথা বলেছিলাম ওখানকার নির্বাচনী লড়াইয়ে প্রধান দুই প্রার্থী আর তাদের দলীয় নেতৃত্বের সাথেও।
‘রেল পেরেছি, রাস্তাও পারব’
ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপি প্রথমবার জলপাইগুড়ি আসনে জিতেছিল ২০১৯ সালে। গতবার যিনি এই আসনে জিতে এমপি হয়েছিলেন, সেই জয়ন্ত রায়ই এবারো দলের প্রার্থী।
ড. রায় তার ভোটের প্রচারে একটা কথা বারবার বলছেন, এবারে জিতলে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ‘তেঁতুলিয়া করিডোরে’র দাবি অবশ্যই বাস্তবায়ন করবে।
কিন্তু তাতে তো বাংলাদেশের সম্মতি দরকার, সেটা নিয়ে কি আদৌ কথাবার্তা হয়েছে?
বিবিসি বাংলাকে জয়ন্ত রায় বলেন, ‘অবশ্যই আলোচনা শুরু হয়েছে। হলদিবাড়ি-চিলাহাটি রেল সংযোগ যদি আমরা চালু করতে পারি, তাহলে এই করিডোরও অবশ্যই পারব।’
তার বক্তব্য, এই করিডোর আসলে জলপাইগুড়ির মানুষের খুবই দরকার। কারণ এটা হলে কলকাতার সাথে ওই জেলার দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার কমে যাবে।
এই প্রস্তাবিত করিডোরটা হলো মূলত জলপাইগুড়ির রাজগঞ্জ ব্লকে চাউলহাটি নামে একটি গ্রাম থেকে শুরু হয়ে, বাংলাদেশের তেঁতুলিয়ার মধ্যে দিয়ে সোয়া চার কিলোমিটার দীর্ঘ একটি রাস্তা হবে। যা অন্য পাড়ে গিয়ে মিশবে উত্তর দিনাজপুর জেলার চোপড়া ব্লকে।
রাস্তার অনেকটা অংশ বাংলাদেশের ভেতরে তৈরিও হয়ে আছে, এখন বিজেপি নেতারা চাইছেন সেটার কাজ শেষ করে তা ভারতীয়দের ব্যবহারের অনুমতি দেয়া হোক।
জেলায় বিজেপির দাপুটে সভাপতি বাপী গোস্বামীর বলেন, “এটা যদি কেউ করে দেখাতে পারেন, তাহলে ‘রাষ্ট্রনায়ক’ ও ‘মুশকিল আসান’ নরেন্দ্র মোদিই পারবেন! বলেও তো আমরা কখনো শুনিনি।”
বস্তুত এটা ঠিকই যে আগরতলা-আখাউড়া রেল সংযোগ থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম-মোংলা বন্দর ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ।
এর বাইরে আরো একগুচ্ছ ‘কানেক্টিভিটি প্রকল্প’ নিয়ে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে আলোচনায় বিস্তর অগ্রগতি হলেও, তেঁতুলিয়ার প্রসঙ্গ দ্বি-পক্ষীয় কোনো বৈঠকে কখনো উঠেছে বলে শোনা যায়নি।
তৃণমূল কংগ্রেস ঠিক সে কারণেই সন্দিহান, নির্বাচনী প্রচারে ‘তেঁতুলিয়া করিডোরে’র প্রসঙ্গ টেনে এনে বিজেপি আসলে জলপাইগুড়ির মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চাইছে।
তবে নির্মল চন্দ্র রায় বলেন, ‘জলপাইগুড়ির মানুষ বুদ্ধিমান। তারা নিশ্চয়ই এ ভাঁওতাবাজিটা ধরে ফেলতে পারবেন।’
চাউলহাটি কী বলছে?
‘তেঁতুলিয়া করিডোর’ যদি কোনোদিন সত্যিই বাস্তবায়িত হয়, তাহলে সেটি শুরু হবে রাজগঞ্জ ব্লকের সীমান্তবর্তী গ্রাম চাউলহাটি বাজারের সংলগ্ন ‘বর্ডার রোড’ থেকে।
চাউলহাটি একটি ছোট্ট শান্ত জনপদ, গ্রামের হিন্দু-মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় সমান, গ্রামের বাজারকে ঘিরেই সামান্য যেটুকু ব্যস্ততা।
চাউলহাটির পাশ ঘেঁষেই সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া, তার দু’পাশে দু’দেশেই আবার রয়েছে মাইলের পর মাইল সবুজ চা-বাগান। একদিকে জলপাইগুড়ির, অন্য দিকে পঞ্চগড় জেলার।
এই চাউলহাটির বাজারে ‘তেঁতুলিয়া করিডোরে’র কথাটা পাড়তেই বোঝা গেল, এটা এই অঞ্চলে খুব আবেগের একটা ইস্যু।
এলাকার প্রবীণ সরস্বতী রায় বলেন, ‘সেই কবে থেকে করিডোরের কথা শুনতে শুনতে আমরা তো বুড়াই হয়ে গেলাম। তবুও আজ যদি সেটা হয়, এলাকার তরুণদের খুব সুবিধা হবে।’
দোকানদার তাপস দেবনাথ আবার বিশ্বাস করেন, আন্তর্জাতিক এই করিডোরটা পেলে শুধু তাদের যে কলকাতা যেতেই অনেক সুবিধে হবে তাই নয়, পুরো এলাকার চেহারাও পাল্টে যাবে অবধারিতভাবে।
৮০ ছুঁই-ছুঁই তৌহিদুল হক আবার খুব স্পষ্ট কথা বলেন, ‘করিডোর পেতে হলে বাংলাদেশকেও তো বিনিময়ে কিছু দিতে হবে। তা আমাদের সরকার কি কিছু ভেবেছে সেটা তারা কী দিতে পারে?’
তরুণ যুবক নূর ইসলাম বিশ্বাস করেন, “দুই ‘বন্ধু প্রধানমন্ত্রী’- শেখ হাসিনা আর নরেন্দ্র মোদি মিলে আলোচনায় বসলে এই করিডোর সমস্যার একটা সমাধান অবশ্যই সম্ভব।”
এলাকার পুরনো বামপন্থী মহেন চন্দ্র রায় আবার মনে করিয়ে দিলেন, ‘আজ বিজেপি ভোটের প্রচারে তেঁতুলিয়া করিডোরের কথা তুললেও সিপিএম কিন্তু প্রায় চার দশক ধরে এই দাবি জানিয়ে আসছে। আগে জলপাইগুড়ি থেকে যখন সিপিএমের মিনতি সেন এমপি ছিলেন, ৩৫ বছর আগে তিনিই কিন্তু পার্লামেন্টে প্রথম তেঁতুলিয়া করিডোরের দাবি তুলেছিলেন।’
তেঁতুলিয়া করিডোরের দাবির সাথে ওই এলাকার মানুষের যে একাত্মতা তা বুঝে নিতে আসলেই কোনো কষ্ট হয় না।
বিজেপিও ঠিক সেই আবেগটাকেই এবারের নির্বাচনে কাজে লাগাতে চাইছে, কিন্তু এই প্রকল্পকে দিনের আলো দেখাতে হলে সবার আগে যে ‘কূটনৈতিক হোমওয়ার্ক’টা দরকার ছিল সেটাই এখনো করে ওঠা হয়নি বিজেপির!
সূত্র : বিবিসি