ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::

কনডেমড সেলের সাথে অন্যান্য সেলের পার্থক্য কী

  • সূর্যোদয় ডেস্ক:
  • আপডেট সময় ০৯:০৫:৫২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪
  • ১০৯৮ বার পড়া হয়েছে

বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ডের সাজা চূড়ান্ত হওয়ার আগে আসামিদের কনডেমড সেলে রাখা অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছে হাইকোর্ট। সোমবার বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি মো: বজলুর রহমানের বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করে।

আদালত রায়ে বলেছে, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির বিচারিক প্রক্রিয়া যেমন- ডেথ রেফারেন্স, আপিল, রিভিউ এবং রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার মতো প্রশাসনিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তাদের কনডেমড সেলে রাখা যাবে না।

এসব ধাপ নিষ্পত্তির পরই কেবল আসামিকে কনডেমড সেলে রাখা যাবে। অর্থাৎ সব ধরনের প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে বলে রায়ে বলা হয়েছে।

একইসাথে এসব ধাপ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আসামিকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিও বলা যাবে না।

রায়ে যা বলেছে হাইকোর্ট
আদালতের রায়ে বিশেষ রোগে আক্রান্ত আসামি ছাড়া কনডেমড সেলে থাকা সকল আসামিকে দু’বছরের মধ্যে সাধারণ সেলে স্থানান্তরিত করতে কারা কর্তৃপক্ষকে আদেশ দেয়া হয়েছে।

হাইকোর্ট রায়ে আরো বলেছে, শারীরিক সমস্যা, যৌন সমস্যা, সংক্রামক রোগের মতো কোনো ব্যাধি থাকলে আসামিকে আলাদা করে রাখা যাবে। তবে এক্ষেত্রে কারাগারে ওই ব্যক্তির বিষয়ে প্রাথমিক শুনানি করতে হবে। তার বক্তব্য নিয়ে তাকে কনডেমড সেলে রাখা যাবে বলে হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে।

বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামিদের জামিনের শুনানি সাধারণত হয় না। এক্ষেত্রে বিচারিক আদালতের রায়ের পর হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স ও আপিল বিচারাধীন থাকাবস্থায় এসব আসামিরা জামিন আবেদন করলে তা বিবেচনা করার পর্যবেক্ষণ দিয়েছে হাইকোর্ট।

একইসাথে উপযুক্ত ক্ষেত্রে আদালত যাতে জামিন বিবেচনা করে এ বিষয়টিও পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছে হাইকোর্ট।

আদালতে রিট শুনানির সময় রাষ্ট্রপক্ষ জানিয়েছিলে, সরকার শিগগিরই নতুন জেলকোড ও নতুন কারা আইন করতে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে নতুন আইন ও বিধিতে যেন রায়ে যেসব নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে তা প্রতিফলিত হয় সে বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছে হাইকোর্ট।

রায়ের পর রিটকারীর আইনজীবী শিশির মনির জানান, ‘মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামিদের বিষয়ে গবেষক, সাংবাদিক বা যে কেউ তথ্য অধিকার আইনে কোনো ধরনের তথ্য জানতে চাইলে তা সরবরাহ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কারা অধিদফতরের মহাপরিচালক, সারাদেশের কারা কর্তৃপক্ষকে এ সব তথ্য সরবরাহ করার আদেশ দেয়া হয়েছে।’

মনির বলেন, ‘হাইকোর্ট রায়ে সাগর-রুনির মামলার কথা উল্লেখ করে বলেছে, প্রায় ১২ বছর ধরে এ মামলার তদন্ত হচ্ছে। এখনো তদন্ত শেষ হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘আদালত বলেছে যে আমাদের দেশে ট্রায়াল স্টেজ শেষ হতে পাঁচ থেকে ১০ বছর সময় লেগে যায়। এ ধরনের দেরি যেখানে হয়, সেখানে মৃত্যুদণ্ডের আসামিকে নির্জন সেলে ১৫ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত যদি বন্দী রাখা হয়। তবে এটি দ্বিগুণ শাস্তি। কারণ নির্জন কক্ষে বাস করা তার সাজা নয়, সাজা মৃত্যুদণ্ড। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের এ বিষয়ে ব্যাখ্যা রয়েছে। ভারতের ওই রায় হাইকোর্টের এ রায় দেয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেছে এমনটা উল্লেখ করেছে হাইকোর্ট।’

একইসাথে সুপ্রিমকোর্ট ও হাইকোর্টের রেজিস্ট্রারের কাছে তথ্য অধিকার আইনে কেউ ডেথ রেফারেন্স বা মৃত্যুদণ্ডাদেশের কোনো তথ্য চাইলে তা সরবরাহ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের গত ৫৩ বছরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সংখ্যা কারা অধিদফতরের ওয়েবসাইটে প্রকাশের নির্দেশও দেয়া হয়েছে।

একইসাথে সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে ও বার্ষিক বিবরণীতে মৃত্যুদণ্ডের সংখ্যা, চূড়ান্তভাবে কত আসামির সাজা কমেছে, কত আসামির মৃত্যুদণ্ড লাঘব হয়েছে এ সংক্রান্ত সকল তথ্য পরিসংখ্যান দিয়ে প্রকাশ করার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। এছাড়াও তথ্য অধিকার আইনে কেউ এসব তথ্য চাইলে তা সরবরাহ করার আদেশ দিয়েছে আদালত।

মৃত্যুদণ্ডের আদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে আসামিদের কনডেম সেলে রাখার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে কনডেমড সেলে থাকা তিন আসামি এ রিট করে। পরের বছর ওই রিটের শুনানি নিয়ে রুল জারি করে হাইকোর্ট। সোমবার দুপুরে রুল নিষ্পত্তি করে এ রায় দেয়া হয়।

মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে এই তিন আসামির করা আপিল এখনো আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে বলে জানিয়েছেন তাদের আইনজীবী শিশির মনির।

রাষ্ট্রপক্ষের প্রতিক্রিয়া
তবে সরকারের সাথে আলোচনার পর এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানান অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন।

রায়ের পর এ এম আমিন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘এ রায় এখনো চূড়ান্ত নয়। দেশে ইতোপূর্বে এ ধরনের রায় হয়নি। এছাড়া এসব বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের এখন পর্যন্ত কোনো রায় নেই। অতএব সরকারের সাথে আলোচনা করে প্রয়োজনে সুপ্রিমকোর্টে যাবে। কারণ সুপ্রিমকোর্ট সিদ্ধান্ত না দেয়া পর্যন্ত কোনো কিছু চূড়ান্ত হয় না।’

তিনি বলেন, ‘সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিমকোর্ট যে আদেশ দেবে তা মানতে বাধ্য হাইকোর্টসহ সব বিচারিক আদালত। আর হাইকোর্টের আদেশ বিচারিক আদালত মানতে বাধ্য। অর্থাৎ সুপ্রিমকোর্ট সিদ্ধান্ত দেয়ার পরই রায় চূড়ান্ত গণ্য হবে। তাই সবার সাথে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে।’

এছাড়া মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের জামিন আবেদন বিবেচনা করার যে পর্যবেক্ষণ রায়ে দেয়া হয়েছে এ বিষয়টি উল্লেখ করে আমিন উদ্দিন বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে এটা হয়নি। সরকারের সাথে এ বিষয়সহ রায়ে দেয়া সব নির্দেশনার বিষয়ে আলোচনা করব।’

ভারতে এখনো মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের কনডেমড সেলে রাখা হয় জানিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘বিশ্বের অন্যান্য দেশের কী অবস্থা রয়েছে সে বিষয়ে তা আমরা খোঁজ নেব। কারণ সুপ্রিমকোর্টে আপিল করার সময় এসব বিষয় প্রয়োজন হবে।’

কনডেমড সেলের সাথে অন্যান্য সেলের পার্থক্য
কারাবিধি অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার পর বন্দীকে কারাগারে সার্বক্ষণিক পাহারায় রাখা, দর্শনার্থীদের সাথে দেখা করার বিষয়ে সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হলেও আলাদা কক্ষে রাখার বিষয়টি নির্দিষ্ট করে উল্লেখিত নেই।

কোনো কারাগারে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামিদের অন্যান্য অপরাধীদের চেয়ে আলাদা ধরনের কক্ষে রাখা হলেও বাংলাদেশের জেল কোড বা কারাবিধি মোতাবেক তেমন কোনো আইন নেই বলে বিবিসি বাংলাকে জানান সাবেক কারা উপ-মহাপরিদর্শক শামসুল হায়দার সিদ্দিকী।

তবে কারা কর্তৃপক্ষ সাধারণ অপরাধীদের চেয়ে কনডেমড সেলের আসামিদের একটু ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেন বলেও মন্তব্য করেন শামসুল হায়দার সিদ্দিকী।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের জেল কোড বা কারাবিধিতে ফাঁসির আসামিদের কনডেমড সেলে রাখার মতো কোনো বিষয় উল্লেখ না থাকলেও তাদের আলাদা ধরনের কক্ষে রাখা হয়ে থাকে। এটিকে এক ধরনের রেওয়াজ বলা যেতে পারে।’

একটি কনডেম সেলে সাধারণত একজন বা তিনজন বন্দী রাখা হয়ে থাকে।

শামসুল হায়দার বলেন, ‘সাধারণত ধারণা করা হয় যে দু’জন বন্দী থাকলে গোপনে পালানোর পরিকল্পনা করতে পারে, তবে তিনজন থাকলে পরিকল্পনা আর গোপন থাকে না। ওই ধারণা থেকেই দু’জন বন্দী একটি কনডেমড সেলে রাখা হয় না।’

কারাবিধি অনুযায়ী, একজন বন্দীর থাকার জন্য ন্যূনতম ৩৬ বর্গফুট (ছয় ফিট বাই ছয় ফিট) জায়গা বরাদ্দ থাকতে হবে। তবে বাংলাদেশের জেলগুলোতে কনডেমড সেলের ক্ষেত্রে এই আয়তন কিছুটা বেশি হয়ে থাকে বলে জানান শামসুল হায়দার সিদ্দিকী।

একজন বন্দী থাকার কনডেমড সেল সাধারণত ১০ ফুট বাই ছয় ফুট আয়তনের হয়ে থাকলেও বাংলাদেশের অনেক জেলেই সেলের মাপ কিছুটা বড় হয়ে থাকে বলে জানান তিনি। আর তিনজন বন্দী যেসব সেলে রাখা হয় সেগুলোর আয়তন আরো বড় হয়ে থাকে।

কনডেমড সেলের ভেতরে আলো-বাতাস চলাচলের জন্য সাধারণত অন্যান্য সেলের তুলনায় অনেক ছোট আকারের জানালা থাকে। আর এসব সেলে থাকা বন্দীদের দিনে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সেলের বাইরে চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়।

শামসুল হায়দার সিদ্দিকী বলেন, ‘একসময় কনডেমড সেলের বন্দীদের নিজেদের সেলের বাইরে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল না। সেল থেকে বছরের পর বছর বের হননি, এমন উদাহরণও আছে। কিন্তু একটা ছোট ঘরের ভেতরে দীর্ঘ সময় থাকতে থাকতে অসুস্থ হয়ে মৃত্যু ঝুঁকি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে, তাই বর্তমানে সব বন্দীকে দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় বাইরে চলাফেরা করতে দেয়া হয়।’

কনডেমড সেলে থাকা বন্দীরা মাসে এক দিন দর্শনার্থীদের সাথে দেখা করার সুযোগ পায়।

তিনি বলেন, ‘আগে একসময় জেলের ভেতরেই কনডেমড সেলে থাকা বন্দীদের সাথে দেখা করতে আসতে পারতো দর্শনার্থীরা। তবে এখন মাসে এক দিন জেল গেটে তারা দর্শনার্থীদের সাথে দেখা করার সুযোগ পান।’

একজন বন্দী একবারে সর্বোচ্চ পাঁচজন দর্শনার্থীর সাথে দেখা করতে পারে। কারা কর্তৃপক্ষ সাধারণত কনডেমড সেলের প্রত্যেক বন্দীর কাছ থেকে তার নিকটাত্মীয়দের তালিকা নেয়, নির্দিষ্ট কয়েকজন ছাড়া কনডেমড সেলের বন্দীর সাথে দেখা করতে অনুমতি দেয় না কারা কর্তৃপক্ষ।

শামসুল হায়দার সিদ্দিকী বলেন, ‘সাধারণত মাসে এক দিন বন্দীদের সাথে দর্শনার্থীদের দেখা করার অনুমতি দেয়া হলেও বিশেষ বিবেচনায় কখনো কখনো ১৫ দিনের মধ্যেও কনডেমড সেলের আসামির সাথে দর্শনার্থীদের দেখা করতে দেয়া হয়।’

উচ্চ আদালতে দণ্ড পরিবর্তিত হলে কী হয়?
মাঝেমধ্যে দেখা যায় কোনো একটি বিচারিক আদালতে কোনো ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়া হলেও পরবর্তীতে উচ্চ আদালতের রায়ে তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ পরিবর্তিত হয়েছে।

বাংলাদেশে এই ধরনের বেশ কিছু ঘটনা রয়েছে যেখানে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামি উচ্চ আদালতে আপিল করার পর তার সাজা কমেছে বা মওকুফ হয়েছে।

আর এ ধরনের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত বিচার পেতে সাধারণত দীর্ঘসময় লেগে থাকে বলে মন্তব্য করেন শামসুল হায়দার সিদ্দিকী।

এসব ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের রায় উচ্চতর আদালত থেকে বাতিল না হওয়া পর্যন্ত কনডেমড সেলেই থাকতে হয় বন্দীকে।

শামসুল হায়দার বলেন, ‘যত দিন পর্যন্ত উচ্চ আদালত মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বাতিল না করছে, তত দিন পর্যন্ত এ বন্দীকে কনডেমড সেলেই থাকতে হয়। কারা বিধি অনুসরণ করে কনডেমড সেল থেকে গিয়েই আদালতের কার্যক্রমে যোগ দিতে হয় বন্দীকে।’

আর এমন অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে বন্দীকে বছরের পর বছর কনডেমড সেলে থাকতে হচ্ছে।

বাংলাদেশে ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্দীদের কনডেমড সেলে থাকার নজির আছে বলে জানান তিনি।
সূত্র : বিবিসি

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

আজকের সূর্যোদয়

আজকের সূর্যোদয় প্রত্রিকায় আপনাদের স্বাগতম। ‍আমাদের নিউজ পড়ুন এবং বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাদের পাশে থাকুন।

বরিশালে মুজিবিয়ানের ৮৭ নেতাকে খুঁজছে গোয়েন্দা সংস্থা

কনডেমড সেলের সাথে অন্যান্য সেলের পার্থক্য কী

আপডেট সময় ০৯:০৫:৫২ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪

বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ডের সাজা চূড়ান্ত হওয়ার আগে আসামিদের কনডেমড সেলে রাখা অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছে হাইকোর্ট। সোমবার বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি মো: বজলুর রহমানের বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করে।

আদালত রায়ে বলেছে, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির বিচারিক প্রক্রিয়া যেমন- ডেথ রেফারেন্স, আপিল, রিভিউ এবং রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনার মতো প্রশাসনিক প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত তাদের কনডেমড সেলে রাখা যাবে না।

এসব ধাপ নিষ্পত্তির পরই কেবল আসামিকে কনডেমড সেলে রাখা যাবে। অর্থাৎ সব ধরনের প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে বলে রায়ে বলা হয়েছে।

একইসাথে এসব ধাপ নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আসামিকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিও বলা যাবে না।

রায়ে যা বলেছে হাইকোর্ট
আদালতের রায়ে বিশেষ রোগে আক্রান্ত আসামি ছাড়া কনডেমড সেলে থাকা সকল আসামিকে দু’বছরের মধ্যে সাধারণ সেলে স্থানান্তরিত করতে কারা কর্তৃপক্ষকে আদেশ দেয়া হয়েছে।

হাইকোর্ট রায়ে আরো বলেছে, শারীরিক সমস্যা, যৌন সমস্যা, সংক্রামক রোগের মতো কোনো ব্যাধি থাকলে আসামিকে আলাদা করে রাখা যাবে। তবে এক্ষেত্রে কারাগারে ওই ব্যক্তির বিষয়ে প্রাথমিক শুনানি করতে হবে। তার বক্তব্য নিয়ে তাকে কনডেমড সেলে রাখা যাবে বলে হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে।

বাংলাদেশে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামিদের জামিনের শুনানি সাধারণত হয় না। এক্ষেত্রে বিচারিক আদালতের রায়ের পর হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স ও আপিল বিচারাধীন থাকাবস্থায় এসব আসামিরা জামিন আবেদন করলে তা বিবেচনা করার পর্যবেক্ষণ দিয়েছে হাইকোর্ট।

একইসাথে উপযুক্ত ক্ষেত্রে আদালত যাতে জামিন বিবেচনা করে এ বিষয়টিও পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছে হাইকোর্ট।

আদালতে রিট শুনানির সময় রাষ্ট্রপক্ষ জানিয়েছিলে, সরকার শিগগিরই নতুন জেলকোড ও নতুন কারা আইন করতে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে নতুন আইন ও বিধিতে যেন রায়ে যেসব নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে তা প্রতিফলিত হয় সে বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছে হাইকোর্ট।

রায়ের পর রিটকারীর আইনজীবী শিশির মনির জানান, ‘মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামিদের বিষয়ে গবেষক, সাংবাদিক বা যে কেউ তথ্য অধিকার আইনে কোনো ধরনের তথ্য জানতে চাইলে তা সরবরাহ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কারা অধিদফতরের মহাপরিচালক, সারাদেশের কারা কর্তৃপক্ষকে এ সব তথ্য সরবরাহ করার আদেশ দেয়া হয়েছে।’

মনির বলেন, ‘হাইকোর্ট রায়ে সাগর-রুনির মামলার কথা উল্লেখ করে বলেছে, প্রায় ১২ বছর ধরে এ মামলার তদন্ত হচ্ছে। এখনো তদন্ত শেষ হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘আদালত বলেছে যে আমাদের দেশে ট্রায়াল স্টেজ শেষ হতে পাঁচ থেকে ১০ বছর সময় লেগে যায়। এ ধরনের দেরি যেখানে হয়, সেখানে মৃত্যুদণ্ডের আসামিকে নির্জন সেলে ১৫ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত যদি বন্দী রাখা হয়। তবে এটি দ্বিগুণ শাস্তি। কারণ নির্জন কক্ষে বাস করা তার সাজা নয়, সাজা মৃত্যুদণ্ড। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের এ বিষয়ে ব্যাখ্যা রয়েছে। ভারতের ওই রায় হাইকোর্টের এ রায় দেয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেছে এমনটা উল্লেখ করেছে হাইকোর্ট।’

একইসাথে সুপ্রিমকোর্ট ও হাইকোর্টের রেজিস্ট্রারের কাছে তথ্য অধিকার আইনে কেউ ডেথ রেফারেন্স বা মৃত্যুদণ্ডাদেশের কোনো তথ্য চাইলে তা সরবরাহ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের গত ৫৩ বছরের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সংখ্যা কারা অধিদফতরের ওয়েবসাইটে প্রকাশের নির্দেশও দেয়া হয়েছে।

একইসাথে সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে ও বার্ষিক বিবরণীতে মৃত্যুদণ্ডের সংখ্যা, চূড়ান্তভাবে কত আসামির সাজা কমেছে, কত আসামির মৃত্যুদণ্ড লাঘব হয়েছে এ সংক্রান্ত সকল তথ্য পরিসংখ্যান দিয়ে প্রকাশ করার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। এছাড়াও তথ্য অধিকার আইনে কেউ এসব তথ্য চাইলে তা সরবরাহ করার আদেশ দিয়েছে আদালত।

মৃত্যুদণ্ডের আদেশ চূড়ান্ত হওয়ার আগে আসামিদের কনডেম সেলে রাখার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে কনডেমড সেলে থাকা তিন আসামি এ রিট করে। পরের বছর ওই রিটের শুনানি নিয়ে রুল জারি করে হাইকোর্ট। সোমবার দুপুরে রুল নিষ্পত্তি করে এ রায় দেয়া হয়।

মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে এই তিন আসামির করা আপিল এখনো আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে বলে জানিয়েছেন তাদের আইনজীবী শিশির মনির।

রাষ্ট্রপক্ষের প্রতিক্রিয়া
তবে সরকারের সাথে আলোচনার পর এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানান অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন।

রায়ের পর এ এম আমিন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘এ রায় এখনো চূড়ান্ত নয়। দেশে ইতোপূর্বে এ ধরনের রায় হয়নি। এছাড়া এসব বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের এখন পর্যন্ত কোনো রায় নেই। অতএব সরকারের সাথে আলোচনা করে প্রয়োজনে সুপ্রিমকোর্টে যাবে। কারণ সুপ্রিমকোর্ট সিদ্ধান্ত না দেয়া পর্যন্ত কোনো কিছু চূড়ান্ত হয় না।’

তিনি বলেন, ‘সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিমকোর্ট যে আদেশ দেবে তা মানতে বাধ্য হাইকোর্টসহ সব বিচারিক আদালত। আর হাইকোর্টের আদেশ বিচারিক আদালত মানতে বাধ্য। অর্থাৎ সুপ্রিমকোর্ট সিদ্ধান্ত দেয়ার পরই রায় চূড়ান্ত গণ্য হবে। তাই সবার সাথে আলোচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে।’

এছাড়া মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের জামিন আবেদন বিবেচনা করার যে পর্যবেক্ষণ রায়ে দেয়া হয়েছে এ বিষয়টি উল্লেখ করে আমিন উদ্দিন বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমাদের দেশে এটা হয়নি। সরকারের সাথে এ বিষয়সহ রায়ে দেয়া সব নির্দেশনার বিষয়ে আলোচনা করব।’

ভারতে এখনো মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের কনডেমড সেলে রাখা হয় জানিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘বিশ্বের অন্যান্য দেশের কী অবস্থা রয়েছে সে বিষয়ে তা আমরা খোঁজ নেব। কারণ সুপ্রিমকোর্টে আপিল করার সময় এসব বিষয় প্রয়োজন হবে।’

কনডেমড সেলের সাথে অন্যান্য সেলের পার্থক্য
কারাবিধি অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার পর বন্দীকে কারাগারে সার্বক্ষণিক পাহারায় রাখা, দর্শনার্থীদের সাথে দেখা করার বিষয়ে সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হলেও আলাদা কক্ষে রাখার বিষয়টি নির্দিষ্ট করে উল্লেখিত নেই।

কোনো কারাগারে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামিদের অন্যান্য অপরাধীদের চেয়ে আলাদা ধরনের কক্ষে রাখা হলেও বাংলাদেশের জেল কোড বা কারাবিধি মোতাবেক তেমন কোনো আইন নেই বলে বিবিসি বাংলাকে জানান সাবেক কারা উপ-মহাপরিদর্শক শামসুল হায়দার সিদ্দিকী।

তবে কারা কর্তৃপক্ষ সাধারণ অপরাধীদের চেয়ে কনডেমড সেলের আসামিদের একটু ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেন বলেও মন্তব্য করেন শামসুল হায়দার সিদ্দিকী।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের জেল কোড বা কারাবিধিতে ফাঁসির আসামিদের কনডেমড সেলে রাখার মতো কোনো বিষয় উল্লেখ না থাকলেও তাদের আলাদা ধরনের কক্ষে রাখা হয়ে থাকে। এটিকে এক ধরনের রেওয়াজ বলা যেতে পারে।’

একটি কনডেম সেলে সাধারণত একজন বা তিনজন বন্দী রাখা হয়ে থাকে।

শামসুল হায়দার বলেন, ‘সাধারণত ধারণা করা হয় যে দু’জন বন্দী থাকলে গোপনে পালানোর পরিকল্পনা করতে পারে, তবে তিনজন থাকলে পরিকল্পনা আর গোপন থাকে না। ওই ধারণা থেকেই দু’জন বন্দী একটি কনডেমড সেলে রাখা হয় না।’

কারাবিধি অনুযায়ী, একজন বন্দীর থাকার জন্য ন্যূনতম ৩৬ বর্গফুট (ছয় ফিট বাই ছয় ফিট) জায়গা বরাদ্দ থাকতে হবে। তবে বাংলাদেশের জেলগুলোতে কনডেমড সেলের ক্ষেত্রে এই আয়তন কিছুটা বেশি হয়ে থাকে বলে জানান শামসুল হায়দার সিদ্দিকী।

একজন বন্দী থাকার কনডেমড সেল সাধারণত ১০ ফুট বাই ছয় ফুট আয়তনের হয়ে থাকলেও বাংলাদেশের অনেক জেলেই সেলের মাপ কিছুটা বড় হয়ে থাকে বলে জানান তিনি। আর তিনজন বন্দী যেসব সেলে রাখা হয় সেগুলোর আয়তন আরো বড় হয়ে থাকে।

কনডেমড সেলের ভেতরে আলো-বাতাস চলাচলের জন্য সাধারণত অন্যান্য সেলের তুলনায় অনেক ছোট আকারের জানালা থাকে। আর এসব সেলে থাকা বন্দীদের দিনে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সেলের বাইরে চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়।

শামসুল হায়দার সিদ্দিকী বলেন, ‘একসময় কনডেমড সেলের বন্দীদের নিজেদের সেলের বাইরে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল না। সেল থেকে বছরের পর বছর বের হননি, এমন উদাহরণও আছে। কিন্তু একটা ছোট ঘরের ভেতরে দীর্ঘ সময় থাকতে থাকতে অসুস্থ হয়ে মৃত্যু ঝুঁকি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে, তাই বর্তমানে সব বন্দীকে দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় বাইরে চলাফেরা করতে দেয়া হয়।’

কনডেমড সেলে থাকা বন্দীরা মাসে এক দিন দর্শনার্থীদের সাথে দেখা করার সুযোগ পায়।

তিনি বলেন, ‘আগে একসময় জেলের ভেতরেই কনডেমড সেলে থাকা বন্দীদের সাথে দেখা করতে আসতে পারতো দর্শনার্থীরা। তবে এখন মাসে এক দিন জেল গেটে তারা দর্শনার্থীদের সাথে দেখা করার সুযোগ পান।’

একজন বন্দী একবারে সর্বোচ্চ পাঁচজন দর্শনার্থীর সাথে দেখা করতে পারে। কারা কর্তৃপক্ষ সাধারণত কনডেমড সেলের প্রত্যেক বন্দীর কাছ থেকে তার নিকটাত্মীয়দের তালিকা নেয়, নির্দিষ্ট কয়েকজন ছাড়া কনডেমড সেলের বন্দীর সাথে দেখা করতে অনুমতি দেয় না কারা কর্তৃপক্ষ।

শামসুল হায়দার সিদ্দিকী বলেন, ‘সাধারণত মাসে এক দিন বন্দীদের সাথে দর্শনার্থীদের দেখা করার অনুমতি দেয়া হলেও বিশেষ বিবেচনায় কখনো কখনো ১৫ দিনের মধ্যেও কনডেমড সেলের আসামির সাথে দর্শনার্থীদের দেখা করতে দেয়া হয়।’

উচ্চ আদালতে দণ্ড পরিবর্তিত হলে কী হয়?
মাঝেমধ্যে দেখা যায় কোনো একটি বিচারিক আদালতে কোনো ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয়া হলেও পরবর্তীতে উচ্চ আদালতের রায়ে তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ পরিবর্তিত হয়েছে।

বাংলাদেশে এই ধরনের বেশ কিছু ঘটনা রয়েছে যেখানে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামি উচ্চ আদালতে আপিল করার পর তার সাজা কমেছে বা মওকুফ হয়েছে।

আর এ ধরনের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত বিচার পেতে সাধারণত দীর্ঘসময় লেগে থাকে বলে মন্তব্য করেন শামসুল হায়দার সিদ্দিকী।

এসব ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের রায় উচ্চতর আদালত থেকে বাতিল না হওয়া পর্যন্ত কনডেমড সেলেই থাকতে হয় বন্দীকে।

শামসুল হায়দার বলেন, ‘যত দিন পর্যন্ত উচ্চ আদালত মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বাতিল না করছে, তত দিন পর্যন্ত এ বন্দীকে কনডেমড সেলেই থাকতে হয়। কারা বিধি অনুসরণ করে কনডেমড সেল থেকে গিয়েই আদালতের কার্যক্রমে যোগ দিতে হয় বন্দীকে।’

আর এমন অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে বন্দীকে বছরের পর বছর কনডেমড সেলে থাকতে হচ্ছে।

বাংলাদেশে ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্দীদের কনডেমড সেলে থাকার নজির আছে বলে জানান তিনি।
সূত্র : বিবিসি