এ পরিস্থিতিতে দেশের আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা আনতে সোনা চোরাচালান বন্ধের তাগিদ দিয়েছেন অংশীজনরা।
বাজুসের মুখপাত্র ও কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য আনোয়ার হোসেন বলেন, দেশের অধিকাংশ জুয়েলারি ব্যবসায়ী সৎ ও সততার সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করেন। কিন্তু প্রচলিত আইনি কাঠামো জুয়েলারি শিল্পবিরোধী। যারা সৎভাবে ব্যবসা করতে চান, তারা কঠিন বাস্তবতার শিকার হচ্ছেন। একটি নীতিমালা হলেও, তার সঠিক বাস্তবায়ন আজও হয়নি। বর্তমান সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ- জুয়েলারি শিল্প বিকাশে কার্যকর উদ্যোগ নিন।
বাজুসের এই নেতা সোনা চোরাচালান বন্ধের দাবি জানিয়ে আরো বলেন, বিদেশে অর্থ পাচার বা হুন্ডি বন্ধ করতে হলে সোনা চোরাচালান বন্ধ করতে হবে। এজন্য সোনা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িতদের ধরতে চিরুনি অভিযান পরিচালনা করতে হবে সরকারকে। ব্যাগেজ রুলের অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে। দেশে বড় বড় আকারের বিদেশি সোনা এবং হীরার অলংকার কোথা থেকে কীভাবে আসে, এই সোনার বৈধ উৎস কী, কোনো বৈধ কাগজপত্র আছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, আগস্ট মাসে প্রবাসীরা ২২২ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন দেশে। এর আগে গত বছর আগস্টে ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ ডলার রেমিট্যান্স দেশে আসে। সূত্র বলছে, মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীদের রক্তে-ঘামে অর্জিত রেমিট্যান্স মার্কিন ডলারের বদলে পাচার হয়ে প্রতিদিন বাংলাদেশ ঢুকেছে অবৈধ সোনা হিসেবে। এই সোনার বড় চালান পুনরায় পাচার হয়েছে দেশের স্থল ও নৌপথে অন্য দেশে। অবৈধভাবে চোরাচালানের ফলে বছরে ৯১ হাজার কোটি টাকা হন্ডিতে পাচার হওয়ার তথ্য দিয়েছে বাজুস। অপরদিকে অব্যাহত ডলারসংকটের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। ফলে ডলারসংকট কাটছে না। ব্যাংকগুলো সময়মতো এলসি খুলতে পারছে না। ব্যাহত হচ্ছে আমদানি-রপ্তানি।
এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন-এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, রিজার্ভের অর্থ হুন্ডিতে আসার ফলে সোনা চোরাচালানসহ সব ধরনের চোরাকারবারি বেড়ে যায়। কেন ৯১ হাজার কোটি টাকার সোনা ও হীরা চোরাচালান হচ্ছে তা সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে খতিয়ে দেখতে হবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, চোরাকারবারিদের ধরতে বিএফআইইউকে সক্রিয় হতে হবে। চোরাচালানে সোনা কীভাবে আসে, সেটাও খতিয়ে দেখতে হবে। পাচার হওয়া সোনা কীভাবে দেশে আসছে, সেই পথ বন্ধ করতে হবে। আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা আনতে চোরাচালান বন্ধের বিকল্প নেই। সর্বশেষ গত ৩ জুন সোনা ও হীরা চোরাচালানে বছরে ৯১ হাজার ২৫০ কোটি টাকা পাচার হওয়ার তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে বাজুস বলেছে, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ৩০টি জেলার সীমান্ত অবস্থিত।
এর মধ্যে খুলনা বিভাগের ৬টি মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশোর ও সাতক্ষীরা জেলা সোনা চোরাচালানের নিরাপদ রুট হয়ে উঠেছে। ভারতে পাচার হওয়া সোনার বড় একটি অংশ এসব জেলার সীমান্ত দিয়ে পাচার হয়ে থাকে। বাজুস চোরাকারবারিদের ধরতে সুপারিশে বলেছে, সোনা ও হীরা চোরাচালানে জড়িতদের ধরতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর জোরালো অভিযান পরিচালনা করা প্রয়োজন। সোনা ও হীরা চোরাচালান প্রতিরোধে বাজুসকে সম্পৃক্ত করে পৃথকভাবে সরকারি মনিটরিং সেল গঠন করা জরুরি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ১০১ দশমিক ৮৯ কোটি টাকার সোনা জব্দ করা হয়েছে।
২০১৪ থেকে ২০২৩ সালে বিজিবি সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে ৯২৫ কেজি সোনা জব্দ করেছে। গত ১০ বছরে শুল্ক গোয়েন্দা, কাস্টম হাউস, বিজিবি, পুলিশ ও এয়ারপোর্ট এপিবিএন সারা দেশে অভিযান চালিয়ে ২ হাজার ৫৮৩ কেজি সোনা জব্দ করে। বিএফআইইউর তথ্য অনুযায়ী, এই সময়কালে সোনা যদি আনুষ্ঠানিক পথে আমদানি করা হতো তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংকে ২২ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ জমা হতো, যা থেকে সরকারের রাজস্ব আহরণ হতো প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা।
ঢাকা কাস্টমস হাউজের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শুধু হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মাধ্যমেই ২০২০ সালে ২ দশমিক ৭৭৫ টন, ২০২১ সালে ২৫ দশমিক ৬৮৯ টন, ২০২২ সালে ৩৫ দশমিক ৭৩৩ টন এবং ২০২৩ সালে ৩১ দশমিক ৪৬৮ টন সোনার বার ব্যাগেজ রুলের আওতায় আমদানি হয়েছে। কাস্টমসের তথ্যমতে, ২০২০ থেকে ২০২২ সালে শিল্পে ব্যবহারের জন্য চারটি চালানে ২ কেজি ১৬০ গ্রাম ডায়মন্ড আমদানি করা হয়েছে। তবে কোনো হীরার অলংকার আমদানি হয়নি। অবৈধ পথে হীরা আসছে। এর বড় কারণ শুল্ক ফাঁকি।
গত ১৯ বছরে এই মূল্যবান রত্ন আমদানিতে সরকার মাত্র ১২ কোটি টাকার রাজস্ব পেয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, দেশের হীরার বাজার প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকার। হীরা চোরাচালানের সঙ্গে কারা জড়িত, তাও দ্রুত চিহ্নিত করতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর জোরালো ভূমিকা প্রয়োজন বলে মনে করছে বাজুস। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের ২ ধারায় সোনা চোরাচালানকে মানি লন্ডারিংয়ের স¤পৃক্ত অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। আইনে সেখানে ১২ বছর পর্যন্ত কারাদ এবং ২০ (বিশ) লাখ টাকা জরিমানা করার বিধান রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, অপরাধীর মূল হোতা আড়ালে থেকে যায় এবং ধরা পড়ে চুনোপুঁটিরা। কিন্তু সে ক্ষেত্রেও আইনের বেড়াজালে জামিনে মুক্তি পেয়ে যাচ্ছে চুনোপুঁটির দল। ফলে চোরাচালান চলছে তাদের নিজস্ব গতিতেই।
সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন