ইউক্রেনে চলছে রাশিয়ার ‘বিশেষ সামরিক অভিযান।’ এই বিশেষ অভিযানের শুরুতে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছিলেন, ইউক্রেনকে ‘নাৎসিমুক্তকরণ’ ও ‘অসামরিকীকরণ’ করাই এ অভিযানের চূড়ান্ত লক্ষ্য। ২০২২ সালের শেষে পৌঁছে স্পষ্ট হয়ে গেছে, ইউক্রেনে জেলেনস্কির সরকার বহাল থাকা পর্যন্ত এ লক্ষ্য পূরণ করতে পারবে না রুশ সেনাবাহিনী।
রুশ সংবাদমাধ্যম কমসমোলস্কায়া প্রাভদায় সাংবাদিক লিউবা লুলকো সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন, ইউক্রেনে বর্তমান রুশ অভিযানের ভূখণ্ডগত লক্ষ্য রয়েছে। বিপ্লবপূর্ব জারের আমলে রাশিয়ার সম্রাট দ্বিতীয় নিকোলাইকে তৎকালীন রাষ্ট্রীয় পরিষদ দুমার সদস্য ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পিওৎর দুর্নোভো বলেছিলেন, ইউক্রেনকে হারাতে হলে তার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে গালিসিয়াকে। পুতিন সেই অতীতের কথা স্মরণে রেখেছেন বলে লুলকো তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন।
ভ্লাদিমির পুতিনকে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম ‘নব্য জার’ হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত হওয়ার পর পুঁজিবাদী রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় দর্শনে কিছুমাত্রায় জার-আমলের ছায়াপাত ঘটেছে বলে তারা মনে করে। এই হিসেবে ‘নব্য জার’ আখ্যা দেওয়া হয় পুতিনকে। এজন্য পুতিন অতীতের জার-আমলের কথা স্মরণ করলে তা গুরুত্ব
পায়। ‘গালিসিয়াকে ইউক্রেনে আত্মসাৎ করা’ একটি আইডিয়া। এই আইডিয়ার ভিত্তিতে বিশেষ সামরিক অভিযানে পুতিনের ভূখণ্ডগত লক্ষ্য সম্পর্কে যে উপসংহারে পৌঁছান যায় তা এইÑ ইভানো-ফ্রান্কিভ্স্ক, ল্ভিভ ও তের্নোপিল অঞ্চল নিয়ে গঠিত গালিসিয়া ছাড়া ইউক্রেনের সমস্ত অঞ্চলই রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে সিংহভাগ অংশই হারাবে ইউক্রেন। এসব অঞ্চল ঐতিহাসিকভাবে ‘ছোট রাশিয়া’ হিসেবে পরিচিত, যা এককালে রুশ সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। এ ছাড়া রয়েছে দোনেৎস্ক, লুগান্স্ক, জাপোরোঝিয়ে (জাপোরিঝ্ঝিয়া) ও খেরসন।
‘ইউক্রেন পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা প্রত্যাখ্যান করে না রাশিয়া, যেমন করে থাকে রাশিয়ার বিরোধীপক্ষ,’ পুতিন বলেছেন বটে। কিন্তু তিনি এও বলেছেন, ‘জীবন ও জনগণের ব্যাপারে আমাদের রয়েছে পৃথক দর্শন, পৃথক মনোভাব।’ ২২ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ইউক্রেনে রুশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালান হচ্ছিল, যা দীর্ঘকাল সহ্য করেছে রাশিয়া। পশ্চিমাদের কথা উল্লেখ করে পুতিন বলেন, ‘তারা বিভক্ত করার চেষ্টা অব্যাহত রাখবে, কিন্তু আমরা ঐক্যের জন্য কাজ করে যাব। রুশ জনগণের একত্রীকরণ কেউ চায় না, কিন্তু আমরা চাই। আমরা এটা করব এবং আমরা করবই।’
প্রেসিডেন্ট পুতিনের এ কথার অর্থ একটাই ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘ হতে চলেছে। শহরাঞ্চলে এই দীর্ঘ যুদ্ধে রাশিয়া হয়তো কার্পেট বম্বিং করবে না ভিয়েতনাম, যুগোস্লভিয়া ও ইরাকে যেটা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র- তবে আক্রমণের বিস্তার ও প্রচণ্ডতা বাড়বে। আরও একটি বিষয় পরিষ্কার, ইউক্রেনে বর্তমান যুদ্ধ যদি আংশিকভাবে গৃহযুদ্ধ হয়, তা হলে এর দ্বিতীয় অংশ হবে ন্যাটোর সঙ্গে যুদ্ধ।
জার্মান সংবাদমাধ্যম নিউ জুর্খের জাইটুং জানিয়েছে, আগামীতে দুটি ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে- এক. রুশ সশস্ত্র বাহিনী এপ্রিল থেকে বড় ধরনের আক্রমণ চালাবে দনবাসে। পরিণতিতে ছত্রখান হয়ে যাবে ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনী, লড়াই করার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলবে তারা। দুই. দনবাস থেকে আক্রমণ করে গোটা ইউক্রেনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে রাশিয়া। বেলারুস থেকে একটি সেনাদল যাবে রাজধানী কিয়েভ দখলে নিতে। রুশ সেনারা পোল্যান্ড সীমান্তে পৌঁছবে পাশ্চাত্য থেকে আসা অস্ত্রের চালান বন্ধ করতে এবং ট্রান্সনিষ্ক্রিয়ার নিয়ন্ত্রণ নেবে।
প্রেসিডেন্ট পুতিন ২১ ডিসেম্বর রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে এক বিবৃতিতে বলেছেন, ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ বিশেষ অভিযান সম্পূর্ণ হলে সেটা হবে কাক্সিক্ষত। অন্যদিকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগু ২০২৩ সালে পরিকল্পিত আক্রমণের কথা বলেছেন। সব কিছু থেকে পরিষ্কার, রাশিয়ার বিশেষ অভিযান সফল হলে বদলে যাবে ইউক্রেনের মানচিত্র।