‘আড়াই মাস আগে তারিখ দেছে, এখন ঘুরিয়্যাও থেরাপি পাওয়া যাইতোছে না। কয় মেশিন সব নষ্ট, থেরাপি হবার নায়।’ রাজধানীর জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেডিও থেরাপি কক্ষের সামনে এভাবেই আক্ষেপ করছিলেন আলেয়া বেগম (৫৩)। কথা বলে জানা যায়, প্রায় এক বছর ধরে স্তন ক্যানসারে ভুগছেন নওগাঁর পত্নীতলার এই বাসিন্দা। শুরুতে জেলা সদর হাসপাতালে, পরে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে রেডিও থেরাপির যন্ত্র দীর্ঘদিন ধরে বিকল থাকায় পাঠানো হয় ক্যানসার ইনস্টিটিউটে।
গত বছরের ৫ ডিসেম্বর আলেয়াকে থেরাপি দেওয়ার জন্য সময় দেওয়া হয়। কিন্তু তিন দফায় আসলেও মেলেনি থেরাপি। সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার আবারও হাসপাতালে আসলে জানতে পারেন রেডিও থেরাপি একেবারে বন্ধ।
এই সময় কথা হয় জরায়ু ক্যানসারে আক্রান্ত রাবেয়া আক্তারের স্বামী সোহেল মিয়ার সঙ্গে। জামালপুরের সরিষাবাড়ীর এই বাসিন্দা কান্নাজড়িত কণ্ঠে আমাদের সময়কে বলেন, ‘দেড় বছর ধরে আমার স্ত্রী জরায়ু ক্যানসারে ভুগছে। ছয় মাস লেগেছে রেডিও থেরাপির তারিখ পেতে। কিন্তু এখন এসে শুনি যেটা চলছিল, সেটাও নাকি নষ্ট। তিন দিন ধরে অপেক্ষায় আছি, বলে মেশিন ঠিক হলে করে দেবে। মেশিনও ঠিক হয় না, থেরাপিও হচ্ছে না। রোগীদের কষ্ট কেউ দেখে না।’
শুধু এই দুই রোগী নন, ক্যানসারে আক্রান্ত হাজার হাজার রেডিও থেরাপি আবশ্যক রোগী পাচ্ছেন না এই চিকিৎসা। ছয়টি যন্ত্রের সর্বশেষটিও এক সপ্তাহ ধরে বিকল। নানা চেষ্টার পরও এখন পর্যন্ত ঠিক করতে পারেননি টেকনিশিয়ানরা। শুধু এই সেবা নয়, হাসপাতালটিতে এক্স-রে, এমআরইসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতির বেশির ভাগই এখন বিকল। এতে করে চরম বিপাকে পড়তে হচ্ছে রোগীদের।
এদিকে সরকারি প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসার অপ্রতুলতা আর বেসরকারিতে মাত্রাতিরিক্ত খরচের ভার নিতে না পারায় অনেকটা বিনা চিকিৎসায় গত ৯ ফেব্রুয়ারি মারা গেছেন বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার মিনু আক্তার। তাকে নিয়ে প্রতিবেদন করেছিল আমাদের সময়। মিনু আক্তারের বোন বিউটি বেগম বলেন, ‘সরকারিতে বিনামূল্যে চিকিৎসা পাওয়ার কথা, সেটি এখন পাওয়া যায় না। থেরাপি ঠিকমতো পেলে আমার বোন আরও অনেক দিন বাঁচত।’
ক্যানসার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন বলেন, ‘চিকিৎসা যন্ত্র যখন নষ্ট থাকবে, তখন চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যু হবে এটাই স্বাভাবিক। এর দায় শুধু হাসপাতালের পরিচালক নয়, অধিদপ্তর, কেন্দ্রীয় ঔষধাগার আর মন্ত্রণালয়েরও। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী ছাড়া এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। দু-একটি কেনার উদ্যোগের কথা আমরা শুনছি; কিন্তু রোগীর তুলনায় তা কিছুই নয়। সেখানেও বছর লেগে যাবে। একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি করে, ক্যানসার হাসপাতালসহ ঢাকার বাইরের মেডিক্যালগুলোর জন্যও একসঙ্গে অন্তত ১০টি যন্ত্র কেনা দরকার।’
দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ক্যানসার চিকিৎসায় দেশের একমাত্র বিশেষায়িত ও সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল। ৫০০ শয্যার এই প্রতিষ্ঠানটিতে সারা বছরই রোগীদের ভিড় লেগে থাকে। প্রতিদিন হাজারের বেশি রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা নেন। এর মধ্যে অর্ধেকেরই প্রয়োজন হয় রেডিও থেরাপির। বেসরকারির তুলনায় এখানে স্বল্প খরচে রেডিও থেরাপি নিতে পারেন রোগীরা। কিন্তু সবগুলো যন্ত্র বিকল হওয়ায় বর্তমানে এখানে পুরোপুরি এই চিকিৎসা বন্ধ রয়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি একেবারে অকেজো। সর্বশেষ একটি দিয়ে থেরাপি কার্যক্রম চলছিল। কিন্তু গত ৮ ফেব্রুয়ারি সেটিও নষ্ট হয়ে যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্যানসার চিকিৎসা চলা নয়টি সরকারি হাসপাতালের মধ্যে ক্যানসার ইনস্টিটিউট ছাড়াও ঢাকা মেডিক্যাল, রাজশাহী, বরিশাল, রংপুর, চট্টগ্রাম ও সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল মিলে মোট ১১টি রেডিও থেরাপি যন্ত্র। তবে দু-একটি ছাড়া সবগুলোই এখন অকেজো। ফলে পুরোপুরিভাবেই রেডিও থেরাপি চিকিৎসাটি সরকারি হাসপাতালে বন্ধ হয়ে গেল। কেবল চালু রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) যন্ত্রটি।
রেডিও থেরাপি বিভাগের এক টেকনোলজিস্ট আমাদের সময়কে বলেন, ‘যে মেশিন ১০ বছর চলার কথা, সেটি ১৫ বছর ধরে চালু রাখা হয়েছে। আর কত চলবে। তারপরও মেরামতের চেষ্টা চলছে, দেখা যাক। নতুন যন্ত্র কেনা ছাড়া কোনো উপায় নেই। রোগীদের কষ্ট দেখতে আর ভালো লাগে না। কবে এ অবস্থার পরিবর্তন হবে বলা যাচ্ছে না।’
ইনস্টিটিউটের রেডিয়েশন অনকোলজি বিভাগের সিনিয়র নার্স নুসরাত আক্তার বলেন, ‘বেসরকারি হাসপাতালে যেখানে তিন থেকে আট হাজার টাকায় একেকবার থেরাপি নিতে হয়, সেখানে সরকারি হাসপাতালে মাত্র ২০০ টাকায়। সবগুলো মেশিন যখন চালু ছিল, রোগীদের জায়গা দেওয়া যেত না। এখন রোগীরা আসে, কিন্তু ফেরত পাঠাতে হচ্ছে। আমরাও বসে বসে দিন পার করছি।’
বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে ইনস্টিটিউটের পরিচালকের কক্ষে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।
পরিচালককে না পেয়ে রেডিও থেরাপি বিভাগের অধ্যাপক ডা. রকিব উদ্দিন আহমেদের কাছে জানতে চাওয়া হলে আমাদের সময়কে তিনি বলেন, ‘সমস্যা দীর্ঘদিনের। সরকারি যে কোনো জিনিস কিনতে গেলে দীর্ঘ প্রক্রিয়া মানতে হয়। রোগীদের কষ্টের সীমা থাকছে না। ২০০ টাকার চিকিৎসা বাইরে থেকে কয়েক হাজার টাকায় নিতে হচ্ছে। এর চেয়ে কষ্টের আর কী আছে। সম্প্রতি নষ্টটা ঠিক করার সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। আশা করা যায় হয়ে যাবে। পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ঔষধাগার, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও আমরাও একটি কেনার উদোগ নিয়েছি।’
জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. রাশিদা সুলতানা আমাদের সময়কে বলেন, ‘রোগীরা চিকিৎসা পাচ্ছে না এটাই সবচেয়ে বড় বিষয়। তাই কীভাবে দ্রুত যন্ত্রগুলো কেনা যায় সেই চেষ্টা চলছে। সমস্যা হচ্ছে প্রক্রিয়ায়। আপাতত তিনটি কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শিগগিরই এগুলো যুক্ত করা গেলে আশা করা যায় পরিস্থিতি কিছুটা হলেও সামাল দেওয়া যাবে।’