সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেনকে আইন অঙ্গনের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেছেন, তার বিদায়ে একটি নক্ষত্রের পতন হলো।
রোববার বেলা সোয়া ৩টায় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী চত্বরে খন্দকার মাহবুব হোসেনের জানাজায় অংশ নিয়ে একথা বলেন প্রধান বিচারপতি।
সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতি, হাজারো আইনজীবী, শুভাকাঙ্ক্ষী ও আত্মীয়স্বজনের অংশগ্রহণে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে প্রবীণ আইনবিদ ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনের জানাজা সম্পন্ন হয়েছে। প্রায় ৬০ বছরের প্রিয় কর্মস্থল থেকে খন্দকার মাহবুব হোসেনকে অশ্রুজলে শেষ বিদায় জানিয়েছেন তার সহকর্মীরা।
নামাজে জানাজায় প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতি, সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সভাপতি ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, এ জে মোহাম্মদ আলী, অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী, জয়নুল আবেদীনসহ হাজারো আইনজীবী অংশগ্রহণ করেন।
জানাজায় অংশ নিয়ে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, ‘খন্দকার মাহবুব হোসেন ছিলেন আইন অঙ্গনের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার বিদায়ে একটি নক্ষত্রের পতন হলো। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টের।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘তিনি (খন্দকার মাহবুব হোসেন) কখনো বিচারকদের ওপর প্রেসার সৃষ্টি করেননি। আপিল ডিসমিস হলেও তিনি হাসতে হাসতে আদালত থেকে বের হতেন। যাবজ্জীবন সাজা মামলা নিয়ে তিনি অসাধারণ কাজ করেছেন। তিনি ১০০ ভাগ আমাদের সহায়তা করার কারণে আমরা এই জাজমেন্ট পেয়েছি।’
জানাজা শেষে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী খন্দকার মাহবুব হোসেনের সম্মানে আগামীকাল সোমবার দ্বিতীয়ার্ধে (দুপুরের পর) আদালতের কার্যক্রমে বিরতি ঘোষণা করেন।
জানাজায় অংশ নিয়ে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বলেন, ‘তিনি আইনের শাসনে বিশ্বাস করতেন। তিনি মানুষকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছেন। আদালতের বিচারকদের সম্মান রক্ষার ব্যাপারে সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন তিনি। তিনি একজন ভালো মানুষ, ভালো আইনজীবী এবং আমাদের আদর্শ ব্যক্তি ছিলেন।’
খন্দকার মাহবুব হোসেনের ছোট ছেলে খন্দকার সয়েব মাহবুব জানান, আগামীকাল সোমবার যোহরের নামাজের পর খিলগাঁও চৌধুরীপাড়া মাটির মসজিদে জানাজা শেষে আজিমপুর গোরস্থানে দাফন করা হবে।
জানাজার আগে খন্দকার মাহবুব হোসেনের জীবনী পাঠ করে শোনান সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুন নুর দুলাল।
জানাজা শেষে প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারপতিরা খন্দকার মাহবুব হোসেনের কফিনে ফুল দিয়ে শ্রোদ্ধা জানান। এরপর সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নেতারা ফুল দেন। জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি এ জে মোহাম্মদ আলী, মহাসচিব ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, সুপ্রিম কোর্ট ইউনিটের সভাপতি আবদুল জব্বার ভূঁইয়া, সাধারণ সম্পাদক গাজী কামরুল ইসলাম সজলের নেতৃত্বে বিএনপি সমর্থক আইনজবীরীরা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এরপর আইনজীবী ফোরাম ঢাকা বার ইউনিটের সভাপতি মাসুদ আহমেদ তালুকদারের নেতৃত্বে আইনজীবীরা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এছাড়া বরিশাল বিভাগীয় আইনজীবী সমিতি ও ঢাকা মেট্রো বার ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানায়।
এর আগে প্রবীণ আইনবিদ খন্দকার মাহবুব হোসেনের প্রথম নামাজে জানাজা ভোর সাড়ে ৬টায় বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ছাপড়া মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়। সকাল ৯টায় দ্বিতীয় জানাজা খন্দকার মাহবুব হোসেন চক্ষু হাসপাতাল মিরপুরে (বিএনএসবি), বিএনপি অফিসের সামনে ১১টায় তৃতীয় জানাজা এবং চৌধুরীপাড়া মাটির মসজিদ ১২টায় চতুর্থ জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
খন্দকার মাহবুব হোসেন শনিবার রাত ১০টা ৪০ মিনিটে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন।
খন্দকার মাহবুব হোসেনের জুনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট শিশির মনির বলেন, রাত ১০টা ৪০ মিনিটে এভারকেয়ার হাসপাতালের দায়িত্বরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে গত কয়েকদিন থেকে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন খন্দকার মাহবুব হোসেন। মেডিক্যাল বোর্ড ও পরিবারের সদস্যদের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে শনিবার রাতে তার ডায়ালাইসিস করা হয়। খন্দকার মাহবুব হোসেনের শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ার মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভেন্টিলেটশন সাপোর্টে নেয়া হয়েছে।
খন্দকার মাহবুব হোসেন ১৯৩৮ সালের ২০ মার্চ বরগুনা জেলার বামনা উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা খন্দকার আবুল হাসান ছিলেন একজন শিক্ষাবিদ। ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন মাহবুব হোসেন। ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল’ অ্যাসোসিয়েশনের ভিপি নির্বাচিত হন। তৎকালীন সামরিক শাসক আইয়ুব খানের জারি করা ১৪৪ ধারা ভঙ করে মিছিল করায় কয়েকজন সহযোগীসহ তিনি পুনরায় গ্রেফতার হন। সামরিক আদালতে তাদের বিচার শুরু হয়। সাহসিকতা ও বিচক্ষণতার সাথে তিনি নিজেই নিজের মামলা পরিচালনা করেন এবং মামলা থেকে অব্যাহতি লাভ করেন। তবে সামরিক শাসক তাকে এমএ পরীক্ষায় অংশ নিতে দেননি। ১৯৬৪ সালে আইন পাস করে তিনি আইন পেশায় যুক্ত হন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় নেপথ্যে থেকে সহায়তা করেন মুক্তিযোদ্ধাদের। ১৯৭১ সালের মার্চের মাঝামাঝিতে হাইকোর্টে আইনজীবীদের একটি মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হলো বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন দেয়ার। মরহুম প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমানসহ আইনজীবীদের নিয়ে জেলা কোর্টে একটি সমাবেশের আয়োজন করেন। ওই সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বক্তব্য দেন তিনি। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধারা তার বাসাকে অস্ত্রাগার হিসেবে ব্যবহার করতেন। আলমারিতে রাখা মোটা আইনি বইয়ের পেছনে লুকিয়ে রাখতেন গ্রেনেড। ১৯৬৭ সালে তিনি হাইকোর্টের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। পরবর্তী সময়ে তিনি আপিল বিভাগের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আদালতের চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে তিনি নিয়োগলাভ করেন। ১৯৮৮ সালের ১৭ জুলাই তিনি বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। তিনি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি পদে চারবার নির্বাচিত হন। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান পদে দুইবার দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি বিয়ে করেছেন অধ্যাপিকা ফারহাত হোসেনকে। দুই ছেলে ও এক কন্যাসন্তানের জনক তিনি।
তিনি সমাজসেবায় বহুমুখী অবদান রেখেছেন। অন্ধ ও পঙ্গুদের জন্য ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের (ভিটিসিবি) ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি তিনি। শিশু সংগঠন কচিকাঁচার উপদেষ্টা এবং জসীমউদদীন পরিষদের পৃষ্ঠপোষক। ওয়ার্ল্ড ব্লাইন্ড ইউনিয়ন, এশিয়ান ব্লাইন্ড ইউনিয়ন ও ঢাকা রোটারি ক্লাবের সদস্য। এসব কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ নানা পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছেন তিনি। জসীমউদদীন স্বর্ণপদক (২০০৬), কবি নজরুল স্বর্ণপদক (২০০৭), ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ স্বর্ণপদকসহ (২০০৮) বিভিন্ন পদকে ভূষিত হন তিনি।
আইনজীবী হিসেবে তিনি অসংখ্য যুগান্তকারী মামলা পরিচালনা করেছেন।